পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OO রবীন্দ্র-রচনাবলী রেখে দিয়েছে, ভারতবর্ষ সেই প্রকৃতির মধ্যে আপনার ভক্তিবৃত্তিকে সর্বত্র ওতপ্রোত করে প্রসারিত করে রেখে দিয়েছে, জগৎকে ভারতবর্ষ পূজার দ্বারা গ্ৰহণ করেছে, তাকে কেবলমাত্র উপভোগের দ্বারা খর্ব করে নি, তাকে ঔদাসীন্যের দ্বারা নিজের কর্মক্ষেত্রের বাইরে দূরে সরিয়ে রেখে দেয় নি ; এ বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে পবিত্র যোগেই ভারতবর্ষ আপনাকে বৃহৎ করে সত্য করে জেনেছে, ভারতবর্ষের তীর্থস্থানগুলি এই কথাই ঘোষণা করছে। বিদ্যালাভ করা কেবল বিদ্যালয়ের উপরেই নির্ভর করে না । প্রধানত ছাত্রের উপরেই নির্ভর করে । অনেক ছাত্র বিদ্যালয়ে যায়, এমনকি, উপাধিও পায়, অথচ বিদ্যা পায় না। তেমনি তীর্থে অনেকেই যায়। কিন্তু তীর্থের যথার্থ ফল সকলে লাভ করতে পারে না । যারা দেখবার জিনিসকে দেখবে না, পাবার জিনিসকে নেবে না, শেষ পর্যন্তই তাদের বিদ্যা পুঁথিগত ও ধর্ম বাহ্য আচারে আবদ্ধ থাকে । তারা তীর্থে যায় বটে কিন্তু যাওয়াকেই তারা পুণ্য মনে করে, পাওয়াকে নয়। তারা বিশেষ জল বা বিশেষ মাটির কোনো বস্তুগুণ আছে বলেই কল্পনা করে ; এতে মানুষের লক্ষ ভ্ৰষ্ট হয়, যা চিত্তের সামগ্ৰী তাকে বস্তুর মধ্যে নির্বাসিত করে নষ্ট করে । আমাদের দেশে সাধনমার্জিত চিত্তশক্তি যতই মলিন হয়েছে এই নিরর্থক বাহ্যিকতা ততই বেড়ে উঠেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে । কিন্তু আমাদের এই দুৰ্গতির দিনের জড়ত্বকেই আমি কোনোমতেই ভারতবর্ষের চিরন্তন অভিপ্ৰায় বলে গ্রহণ করতে পারি। নে । কোনো একটি বিশেষ নদীর জলে স্নান করলে নিজের অথবা ত্রিকোটিসংখ্যক পূর্বপুরুষের পারলৌকিক সদগতি ঘটার সম্ভাবনা আছে, এ বিশ্বাসকে আমি সমূলক বলে মেনে নিতে রাজি নই এবং এ বিশ্বাসকে আমি বড়ো জিনিস বলে শ্রদ্ধা করি নে। কিন্তু অবগাহনমানের সময় নদীর জলকে যে ব্যক্তি যথার্থ ভক্তির দ্বারা সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনে গ্ৰহণ করতে পারে, আমি তাকে ভক্তির পাত্র বলেই জ্ঞান করি। কারণ, নদীর জলকে সামান্য তরল পদাৰ্থ বলে সাধারণ মানুষের যে একটা স্কুল সংস্কার, একটা তামসিক অবজ্ঞা আছে, সাত্ত্বিকতার দ্বারা অর্থাৎ চৈতন্যময়তার দ্বারা সেই জড় সংস্কারকে সে লোক কাটিয়ে উঠেছে— এইজন্যে নদীর জলের সঙ্গে কেবলমাত্র তার শারীরিক ব্যবহারের বাহ্য সংস্রব ঘটে নি, তার সঙ্গে তার চিত্তের যোগসাধন হয়েছে। এই নদীর ভিতর দিয়ে পরম চৈতন্য তার চেতনাকে এক ভাবে স্পর্শ করেছেন । সেই স্পর্শের দ্বারা মানের জল কেবল তার দেহের মলিনতা নয়, তার চিত্তেরও মোহপ্রলেপ মার্জনা করে দিচ্ছে । অগ্নি জল মাটি অন্ন প্রভৃতি সামগ্ৰীর অনন্ত রহস্য পাছে অভ্যাসের দ্বারা আমাদের কাছে একেবারে মলিন হয়ে যায়। এইজন্যে প্রত্যহই নানা কর্মে নানা অনুষ্ঠানে তাদের পবিত্রতা আমাদের স্মরণ করবার বিধি আছে। যে লোক চেতনভাবে তাই স্মরণ করতে পারে, তাদের সঙ্গে যোগে ভূমীর সঙ্গে আমাদের যোগ এ কথা যার বোধশক্তি স্বীকার করতে পারে, সে লোক খুব একটি মহৎ সিদ্ধি লাভ করেছে। স্নানের জলকে আহারের অন্নকে শ্রদ্ধা করবার যে শিক্ষা সে মূঢ়তার শিক্ষা নয়, তাতে জড়িত্বের প্রশ্রয় হয় না, কারণ, এই সমস্ত অভ্যস্ত সামগ্ৰীকে তুচ্ছ করাই হচ্ছে জড়তা, তার মধ্যেও চিত্তের উদবোধন এ কেবল চৈতন্যের বিশেষ বিকাশেই সম্ভবপর। অবশ্য, যে ব্যক্তি মূঢ়, সত্যকে গ্রহণ করতে যার প্রকৃতিতে স্থূল বাধা আছে, সমস্ত সাধনাকেই সে বিকৃত করে এবং লক্ষ্যকে সে কেবলই ভুল জায়গায় স্থাপন করতে থাকে। এ কথা বলাই বাহুল্য। বহুকোটি লোক, প্ৰায় একটি সমগ্ৰ জাতি, মৎস্য মাংস-আহার একেবারে পরিত্যাগ করেছে- “ পৃথিবীতে কোথাও এর তুলনা পাওয়া যায় না। মানুষের মধ্যে এমন জাতি দেখি নে যে আমিষ আহার क्रा द6 | "- ভারতবর্ষ এই যে আমিষ পরিত্যাগ করেছে সে কৃষ্ট্ৰব্ৰত সাধনের জন্যে নয়, নিজের শরীরকে পীড়া দিয়ে কোনাে শাস্ত্রোপদিষ্ট পুণ্যলাভের জন্যে নয়। তার একমাত্র উদ্দেশ্য- জীবের প্রতি হিংসা ত্যাগ করা । । এই হিংসা ত্যাগ না করলে জীবের সঙ্গে জীবের যোগসামঞ্জস্য নষ্ট হয়। প্রাণীকে যদি আমরা খেয়ে