পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ OS রবীন্দ্র-রচনাবলী নয়, আমাদের কামনা আছে বলেই ; লোভের জিনিসকে আমরা বড়ো দেখি, সে জিনিসটা সতাই বড়ো বলে নয়, আমাদের লোভ আছে বলেই । এইজন্যে ব্ৰহ্মচর্যের সংযমের দ্বারা বোধশক্তিকে বাধামুক্ত করবার শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক । ভোগবিলাসের আকর্ষণ থেকে অভ্যাসকে মুক্তি দিতে হয়, যে-সমস্ত সাময়িক উত্তেজনা লোকের চিত্তকে ক্ষুব্ধ এবং বিচারবুদ্ধিকে সামঞ্জস্যভ্রষ্ট করে দেয় তার ধাক্কা থেকে বঁচিয়ে বুদ্ধিকে সরল করে বাড়তে দিতে হয় । - যেখানে সাধনা চলছে, যেখানে জীবনযাত্রা সরল ও নির্মল, যেখানে সামাজিক সংস্কারের সংকীর্ণতা নেই, যেখানে ব্যক্তিগত ও জাতিগত বিরোধবুদ্ধিকে দমন করবার চেষ্টা আছে, সেইখানেই ভারতবর্ষ যাকে বিশেষভাবে বিদ্যা বলেছে তাই লাভ করবার স্থান । আমি জানি অনেকেই বলে উঠবেন এ একটা ভাবুকতার উচ্ছাস, কাণ্ডজ্ঞানবিহীনের দুরাশামাত্র । কিন্তু সে আমি কোনোমতেই স্বীকার করতে পারি নে। যা সত্য তা যদি অসাধ্য হয় তবে তা সতাই নয় । অবশ্য, যা সকলের চেয়ে শ্রেয় তাই যে সকলের চেয়ে সহজ। তা নয়, সেইজন্যেই তার সাধনা চাই । আসলে, প্রথম শক্ত হচ্ছে সত্যের প্রতি শ্ৰদ্ধা করা । টাকা জিনিসটার দরকার আছে এই বিশ্বাস যখন ঠিক মনে জন্মায় তখন এ আপত্তি আমরা আর করি নে যে, টাকা উপার্জন করা শক্ত । তেমনি ভারতবর্ষ যখন বিদ্যাকেই নিশ্চয়রূপে শ্রদ্ধা করেছিল তখন সেই বিদ্যালাভের সাধনাকে অসাধ্য বলে হেসে উড়িয়ে দেয় নি। তখন তপস্যা আপনি সত্য হয়ে উঠেছিল । অতএব প্রথমত দেশের সেই সত্যের প্রতি দেশের লোকের শ্রদ্ধা যদি জন্মে। তবে দুৰ্গম বাধার মধ্য দিয়েও তার পথ আপনিই তৈরি হয়ে উঠবে। বর্তমানকালে এখনই দেশে এইরকম তপস্যার স্থান, এইরকম বিদ্যালয় যে অনেকগুলি হবে। আমি এমনতরো আশা করি নে । কিন্তু আমরা যখন বিশেষভাবে জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে সম্প্রতি জাগ্রত হয়ে উঠেছি, তখন ভারতবর্ষের বিদ্যালয় যেমনটি হওয়া উচিত। অন্তত তার একটি মাত্র আদর্শ দেশের নানা চাঞ্চল্য নানা বিরুদ্ধভাবের আন্দোলনের উর্ধের্ব জেগে ওঠা দরকার হয়েছে। ন্যাশনাল বিদ্যাশিক্ষা বলতে য়ুরোপ যা বোঝে আমরা যদি তাই বুঝি তবে তা নিতান্তই বোঝার ভুল হবে । আমাদের দেশের কতকগুলি বিশেষ সংস্কার, আমাদের জাতের কতকগুলি লোকচার, এইগুলির দ্বারা সীমাবদ্ধ করে আমাদের স্বাজাত্যের অভিমানকে অত্যুগ্র করে তোেলবার উপায়কে আমি কোনােমতে ন্যাশনাল শিক্ষা বলে গণ্য করতে পারি নে। জাতীয়তাকে আমরা পরম পদাৰ্থ বলে পূজা করি। নে এইটেই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা ! ভূমৈব সুখং, নায়ে সুখমস্তি, ভূমীত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃএইটিই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তার মন্ত্র । প্রাচীন ভারতের তপোবনে যে মহাসাধনার বনস্পতি একদিন মাথা তুলে উঠেছিল এবং সর্বত্র তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে সমাজের নানা দিককে অধিকার করে নিয়েছিল, সেই ছিল আমাদের ন্যাশনাল সাধনা । সেই সাধনা যোগসাধনা | যোগসাধনা কোনো উৎকট শারীরিক মানসিক ব্যায়ামচৰ্চা নয় । যোগসাধনা মানে সমস্ত জীবনকে এমনভাবে চালনা করা যাতে স্বাতন্ত্র্যের দ্বারা বিক্রমশালী হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য না হয়, মিলনের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠাকেই আমরা চরম পরিণাম বলে মনিঐশ্বৰ্যকে সঞ্চিত করে তোলা নয়, আত্মাকে সত্যে উপলব্ধি করাই আমরা সফলতা বলে স্বীকার করি । বহু প্ৰাচীনকালে একদিন অরণ্যসংকুল ভারতবর্ষে আমাদের আর্য পিতামহেরা প্রবেশ করেছিলেন । আধুনিক ইতিহাসে যুরোপীয়দল ঠিক তেমনি করেই নূতন আবিষ্কৃত মহাদ্বীপের মহারণ্যে পথ উদঘাটন করেছেন। তঁদের মধ্যে সাহসিকগণ অগ্রগামী হয়ে অপরিচিত ভূখণ্ডসকলকে অনুবতীদের জন্যে অনুকুল করে নিয়েছেন। আমাদের দেশেও অগস্ত্য প্রভৃতি ঋষিরা অগ্রগামী ছিলেন। র্তারা অপরিচিত । দুৰ্গমতার বাধা অতিক্রম করে গহন অরণ্যকে বাসোপযোগী করে তুলেছিলেন। পূর্বতন অধিবাসীদের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই তখনো যেমন হয়েছিল এখনো তেমনি হয়েছে। কিন্তু এই দুই ইতিহাসের ধারা যদিও ঠিক একই অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তবু একই সমুদ্রে এসে পীেছোয় নি।