পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१०४ রবীন্দ্র-রচনাবলী SO V\3? কবির কাব্যের মধ্যে যেমন কবির পরিচয় থাকে তেমনি এই যে শান্তিনিকেতন আশ্রমটি তৈরি হয়ে উঠেছে, উঠেছে কেন, প্রতিদিনই তৈরি হয়ে উঠছে, এর মধ্যে একটি জীবনের পরিচয় আছে। সেই জীবন কী চেয়েছিল এবং কী পেয়েছিল তা এই আশ্রমের মধ্যে যেমন করে লিখে গিয়েছে এমন আর কোথাও লিখে যেতে পারে নি। অনেক বড়ো বড়ো রাজা তাম্রশাসনে শিলালিপিতে তাদের জয়লব্ধ রাজ্যের কথা ক্ষোদিত করে রেখে যান । কিন্তু এমন লিপি কোথায় পাওয়া যায় । এমন অবাধ মুণ্ডু মুদ্র উদার আকাশে, এমন জীবনময় অক্ষর- এমন ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তনশীল নব নব दge: মহর্ষি তীর জীবনে অনেক সভা স্থাপন করেছেন, অনেক ব্ৰাহ্মসমাজগৃহের প্রতিষ্ঠা করেছেন, অনেক উপদেশ দিয়েছেন, অনেক গ্ৰন্থ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সে-সমস্ত কাজের সঙ্গে তার এই আশ্রমের একটি পার্থক্য আছে। যেমন গাছের ডাল থেকে খুঁটি হতে পারে, তাকে চিরে তার থেকে নানা প্রকার জিনিস তৈরি হতে পারে, কিন্তু সেই গাছে যে ফুলটি ফোটে, যে ফলটি ধরে সে এই সমস্ত জিনিস থেকেই পৃথক, তেমনি মহর্ষির জীবনের অন্যান্য সমস্ত কর্মের থেকে এই আশ্রমের একটি বিশিষ্টতা আছে । এর জন্যে তাকে চিন্তা করতে হয় নি, চেষ্টা করতে হয় নি, বাইরের লোকের সঙ্গে মিলতে হয় নি, চারি দিকের সঙ্গে কোনো ঘাত-প্ৰতিঘাত সহ্য করতে হয় নি । এ তার জীবনের মধ্যে থেকে একটি মূর্তি ধরে আপনা-আপনি উদ্ভিন্ন হয়ে উঠেছে। এইজন্যেই এর মধ্যে এমন একটি সৌন্দর্য, এমন একটি সম্পূর্ণত রয়ে গেছে। এইজন্যেই এর মধ্যে এমন একটি সুধাগন্ধ, এমন একটি মধুসঞ্চয়। এইজনেই এর মধ্যে তীর আত্মপ্ৰকাশ যেমন সহজ যেমন গভীর এমন আর কোথাও নেই । এই আশ্রমে আছে কী ? মাঠ এবং আকাশ এবং ছায়াগাছগুলি, চারি দিকে একটি বিপুল অবকাশ এবং নির্মলতা। এখানকার আকাশে মেঘের বিচিত্ৰ লীলা এবং চন্দ্ৰসূৰ্য গ্ৰহতারার আবর্তন কিছুতে আচ্ছন্ন হয়ে নেই। এখানে প্ৰান্তরের মাঝখানে ছোটাে বনটিতে ঋতুগুলি নিজের মেঘ-আলো বর্ণগন্ধ ফুলফল— নিজের সমস্ত বিচিত্র আয়োজন নিয়ে সম্পূর্ণ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়। কোনো বাধার মধ্যে তাদের খর্ব হয়ে থাকতে হয় না। চার দিকে বিশ্বপ্রকৃতির এই অবাধ প্রকাশ এবং তার মাঝখানটিতে 'শান্তংশিবমদ্বৈতম-এর দুই সন্ধ্যা নিত্য আরাধনা— আর কিছুই নয়। গায়গ্ৰীমন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে, উপনিষদের মন্ত্র পঠিত হচ্ছে, স্তবগান ধ্বনিত হচ্ছে, দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর, সেই নিভৃতে, সেই নির্জনে, সেই বনের মর্মরে, সেই পাখির কৃজনে, সেই উদার আলোকে, সেই নিবিড় ছায়ায় । o এই আশ্রমের মধ্যে থেকে দুটি সুর উঠেছে— একটি বিশ্বপ্রকৃতির সুর, একটি মানবাত্মার সুর। এই দুটি সুরধারার সংগমের মুখেই এই তীর্থটি স্থাপিত। এই দুটি সুরই অতি পুরাতন এবং চিরদিনই নূতন । এই আকাশ নিরন্তর যে নীরব মন্ত্র জপ করছে সে আমাদের পিতামহেরা আর্যাবর্তের সমতল প্রান্তরের উপরে নিঃশব্দে দাড়িয়ে কত শতাব্দী পূর্বেও চিত্তের গভীরতার মধ্যে গ্রহণ করেছেন। এই যে বনটির পল্লবঘন নিস্তব্ধতার মধ্যে নিবিষ্ট হয়ে ছায়া এবং আলো দুই ভাই বোনে মিলে পৃথিবীর উপরে দেখেছেন যেদিন তঁরা সরস্বতীর কুলে প্রথম কুটির নির্মাণ করতে আরম্ভ করেছেন। এ সেই আকাশ, এ সেই ছায়ালোক, এ সেই অনির্বচনীয় একটি প্রকাশের ব্যাকুলতা, যার দ্বারা সমস্ত শূন্যকে ক্রন্দিত করে শুনেছিলেন বলেই ঋষি-পিতামহেরা এই অন্তরীক্ষকে ক্ৰন্দসী নাম দিয়েছিলেন। আবার এখানে মানবের কণ্ঠ থেকে যে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে সেও কত যুগের প্রাচীন বাণী । পিতা নোহসি, পিতা নোবোধি, নমস্তেহস্তু- এই কথাটি কত সরল, কত পরিপূর্ণ এবং কত পুরাতন । যে