পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a〉の রবীন্দ্র-রচনাবলী সঙ্গী ছিলেন। যখন বৈরাগ্য উপস্থিত হল, যখন ধর্মের জন্য র্তার ব্যাকুলত জন্মাল, তখন এই অভ্যস্ত গুৰুত্ব ল’কে চুটি গেলন ‘ভক্তিবৃত্তিরে বাস্ত কের রাখার উপকরণ ঠােঙার খুব র্তার ভক্তিকে যে এই দিকে তিনি কখনো নিয়োজিত করেন নি তা নয় । তিনি যখন বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যেতেন পথিমধ্যে দেবীমন্দিরে ভক্তিভরে প্রণাম করতে ভুলতেন না ; তিনি একবার এত সমারোহে সরস্বতীর পূজা করেছিলেন যে সেবার পূজার দিনে শহরে গাদ্দাফুল দুর্লভ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যেদিন শ্মশানঘাটে পূর্ণিমার রাতে তীর চিত্ত জাগ্রত হয়ে উঠল সেদিন এই সকল চিরাভ্যস্ত পথকে তিনি পথ বলেই লক্ষ্য করলেন না। তীর তৃষ্ণার জল যে এ দিকে নেই তা বুঝতে তাকে চিন্তামাত্র করতে হয় নি । অন্তঃপুরে তীর ডাক পড়েছিল। তিনি জগতের মধ্যেই জগদীশ্বরকে, অন্তরাত্মার মধ্যেই পরমাত্মাকে দর্শন করতে চেয়েছিলেন । তাকে আর কিছুতে ভুলিয়ে রাখে কার সাধ্য ! যারা নানা ক্রিয়াকর্মে আপনাকে ব্যাপৃত রাখতে চায় তাদের নানা উপায় আছে, যারা ভক্তির মধুর রসকে আস্বাদন করতে চায় তাদেরও অনেক উপলক্ষ মেলে। কিন্তু যারা একেবারে তাকেই চেয়ে বসে, তাদের তো ঐ একটি বৈ আর দ্বিতীয় কোনো পন্থা নেই। তারা কি আর বাইরে ঘুরে বেড়াতে পারে ? তাদের সামনে কোনো রঙিন জিনিস সাজিয়ে তাদের কি কোনোমতেই ভুলিয়ে রাখা যায় ? নিখিলের মধ্যে এবং আত্মার মধ্যে তাদের প্রবেশ করতেই হবে । কিন্তু এই অধ্যাত্মলোকের এই বিশ্বলোকের মন্দিরের পথ তীর চার দিকে যে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অন্তরের ধনকে দূরে সন্ধান করবার প্রণালীই যে সমাজে চারি দিকে প্রচলিত ছিল। এই নির্বাসনের মধ্যে থেকেই তো তার সমস্ত প্ৰাণ কেঁদে উঠেছিল। তার আত্মা যে আশ্রয় চাচ্ছিল, সে আশ্রয় বাইরের খণ্ডতর রাজ্যে সে কোথায় খুঁজে পাবে ? আত্মার মধ্যেই পরমাত্মাকে, জগতের মধ্যেই জগদীশ্বরকে দেখতে হবে, এই কথাটি এতই অত্যন্ত সহজ যে হঠাৎ মনে হয় এ নিয়ে এত খোজাখুঁজি কেন, এত কান্নাকাটি কিসের জন্যে ? কিন্তু বরাবর মানুষের ইতিহাসে এই ঘটনাটি ঘটে এসেছে। মানুষের প্রবৃত্তি কিনা বাইরের দিকে ছোটবার জন্যে সহজেই প্রবণ, এই কারণে সেই ঝোকের মাথায় সে মূল কেন্দ্রের আকর্ষণ এড়িয়ে শেষে কোথায় গিয়ে পীেছোয় তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। সে বাহ্যিকতাকেই দিনে দিনে এমনি বৃহৎ ও জটিল করে দাড় করায় যে অবশেষে একদিন আসে, যখন যা তার আন্তরিক, যা তার স্বাভাবিক, তাকেই খুঁজে বের করা তার পক্ষে সকলের চেয়ে কঠিন হয়ে ওঠে । এত কঠিন হয় যে তাকে সে আর খোজেই না, তার কথা সে ভুলেই যায়, তাকে আর সত্য বলে উপলব্ধিই করে না ; বাহ্যিকতাকেই একমাত্র জিনিস বলে জানে, আর কিছুকে বিশ্বাসই করতে পারে না। মেলার দিনে ছোটাে ছেলে মার হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় । কিন্তু তার মন কিনা চার দিকে, এইজন্যে মুঠো। কখন সে ছেড়ে দেয় ; তার পর থেকেই ভিড়ের মধ্যে, গােলমালের মধ্যে, কেবলই সে বাইরে থেকে বাইরে, দূর থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। ক্রমে মাের কথা তার আর মনেই থাকে না, বাইরের যে-সমস্ত সামগ্ৰী সে দেখে সেইগুলিই তার সমস্ত হৃদয়কে অধিকার করে বড়ো হয়ে ওঠে। যে মা তার সব চেয়ে আপন তিনিই তার কাছে সব চেয়ে ছায়াময়, সব চেয়ে দূর হয়ে ওঠেন। শেষকালে এমন হয় যে অন্য সমস্ত জিনিসের মধ্যেই সে আহত প্ৰতিহত হয়ে বেড়ায়, কেবল নিজের মাকে খুঁজে পাওয়াই সন্তানের পক্ষে সব চেয়ে কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের সেই দশা ঘটে । এমন সময়ে এক-একজন মহাপুরুষ জন্মান যারা সেই অনেক-দিনকার-হারিয়ে-যাওয়া স্বাভাবিকের জন্যে আপনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। যার জন্যে চার দিকের কারও কিছুমাত্র দরদ নেই তারই জন্যে তাদের কান্না কোনােমতেই থামতে চায় না। তারা এক মুহুর্তে বুঝতে পারেন আসল জিনিসটি আছে অথচ কোথাও তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না । সেইটিই একমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিস, অথচ কেউ