পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন SS তার কোনাে খোজ করছে না। জিজ্ঞাসা করলে, হয় হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে, নয় ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে আঘাত করতে আসছে । এমনি করে যেটি সহজ, যেটি স্বাভাবিক, যেটি সত্য, যেটি না হলে নয়, পৃথিবীতে এক-একজন লোক আসেন সেটিকেই খুঁজে বের করতে। ঈশ্বরের এই এক লীলা- যেটি সব চেয়ে সহজ তাকে তিনি শক্ত করে তুলতে দেন— যা নিতান্তই কাছের তাকে তিনি হারিয়ে ফেলতে দেন— পাছে সহজ বলেই তাকে না দেখতে পাওয়া যায়, পাছে খুঁজে বের করতে না হলে তার সমস্ত তাৎপর্যটি আমরা না পাই। যিনি আমাদের অন্তরতর তীর মতো এত সহজ আর কী আছে। তিনি আমাদের নিশ্বাসপ্রশ্বাসের চেয়ে সহজ, তবু তাকে আমরা হারাই, সে কেবল তাকে আমরা খুঁজে বের করব বলেই। হঠাৎ যখন তিনি ধরা পড়েন, হঠাৎ যখন কেউ হাততালি দিয়ে বলে ওঠে এই যে এইখানেই, আমরা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করি।- কই ? কোথায় ? এই যে হৃদয়ের হৃদয়ে, এই যে আত্মার আত্মায়। যেখানে তীকে পাওয়ার বড়েই দরকার, সেইখানেই তিনি বরাবর বসে আছেন, কেবল আমরাই দূরে দূরে ছুটােছুটি করে মরছিলুম, এই সহজ কথাটি বােঝার জন্যেই— এই যিনি অত্যন্তই কাছে আছেন তাকেই খুঁজে পাবার জন্যে এক-একজন লোকের এত কান্নার দরকার । এই কান্না মিটিয়ে দেবার জন্যে যখনই তিনি সাড়া দেন তখনই ধরা পড়ে যান । তখনই সহজ। আবার সহজ হয়ে আসে । নিজের রচিত জটিল জাল ছেদন করে চিরন্তন আকাশ চিরন্তন আলোকের অধিকার আবার ফিরে পাবার জন্য মানুষকে চিরকালই এইরকম মহাপুরুষদের মুখ তাকাতে হয়েছে। কেউ বা ধর্মের ক্ষেত্রে, কেউ বা জ্ঞানের ক্ষেত্রে, কেউ বা কর্মের ক্ষেত্রে এই কাজে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যা চিরদিনের জিনিস তাকে তঁরা ক্ষণিকের আবরণ থেকে মুক্ত করবার জন্যে পৃথিবীতে আসেন। বিশেষ স্থানে গিয়ে বিশেষ মন্ত্র পড়ে বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায় এই বিশ্বাসের অরণ্যে যখন মানুষ পথ হারিয়েছিল, তখন বুদ্ধদেব এই অত্যন্ত সহজ কথাটি আবিষ্কার ও প্রচার করবার জন্যে এসেছিলেন যে, স্বাৰ্থত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললে তবেই মুক্তি হয়। কোনাে। স্থানে গেলে বা জলে স্নান করলে বা অগ্নিতে আহুতি দিলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে হয় না । এই কথাটি শুনতে নিতান্তই সরল, কিন্তু এই কথাটির জন্যে একটি রাজপুত্রকে রাজ্যত্যাগ করে বনে বনে পথে পথে ফিরতে হয়েছে— মানুষের হাতে এটি এতই কঠিন হয়ে উঠেছিল। য়িহুদিদের মধ্যে ফ্যারিসি সম্প্রদায়ের অনুশাসনে যখন বাহা নিয়মপালনই ধর্ম বলে গণ্য হয়ে উঠেছিল, যখন তারা নিজের গণ্ডির বাইরে অন্য জাতি অন্য ধর্মপন্থীদের ঘূণা করে তাদের সঙ্গে একত্রে আহার বিহার বন্ধ করাকেই ঈশ্বরের বিশেষ অভিপ্ৰায় বলে স্থির করেছিল, যখন য়িহুদিরা ধর্মানুষ্ঠান য়িহুদি জাতিরই নিজস্ব স্বতন্ত্র সামগ্ৰী হয়ে উঠেছিল, তখন যিশু এই অত্যন্ত সহজ কথাটি বলবার জন্যেই এসেছিলেন যে, ধর্ম অন্তরের সামগ্ৰী, ভগবান অন্তরের ধন, পাপপুণ্য বাহিরের কৃত্রিম বিধি-নিষেধের অনুগত নয়- সকল মানুষই ঈশ্বরের সন্তান, মানুষের প্রতি ঘূণাহীন প্রেম ও পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাসপূর্ণ ভক্তির দ্বারাই ধৰ্মসাধনা হয়— বাহ্যিকতা মৃত্যুর নিদান, অন্তরের সার পদার্থেই প্ৰাণ পাওয়া যায়। কথাটি এতই অত্যন্ত সরল যে শোনাবামাত্ৰই সকলকেই বলতে হয় যে, ই । কিন্তু, তবুও এই কথাটিকেই সকল দেশেই মানুষ এতই কঠিন করে তুলেছে যে, এর জন্যে যিশুকে মরুপ্রাস্তরে গিয়ে তপস্যা করতে এবং ক্রুসের উপরে অবমানিত মৃত্যুদণ্ডকে গ্রহণ করতে হয়েছে। মহম্মদকেও সেই কাজ করতে হয়েছিল। মানুষের ধর্মবুদ্ধি খণ্ড খণ্ড হয়ে বাহিরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাকে তিনি অন্তরের দিকে, অখণ্ডের দিকে, অনন্তের দিকে নিয়ে গিয়েছেন । সহজে পারেন নি, এর জন্যে সমস্ত জীবন তাকে মৃত্যুসংকুল দুৰ্গম পথ মাড়িয়ে চলতে হয়েছে, চারি দিকের শক্ৰতা ঝড়ের সমুদ্রের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তীকে নিরস্তর আক্রমণ করেছে। মানুষের পক্ষে যা যথার্থস্বাভাবিক, যা সরল সত্য, তাকেই স্পষ্ট অনুভব করতে ও উদ্ধার করতে, মানুষের মধ্যে যারা সর্বোচ্চশক্তিসম্পন্ন তাদেরই প্রয়োজন হয় । , 虫 মানুষের ধর্মরাজ্যে যে তিনজন মহাপুরুষ সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিরোহণ করেছেন এবং ধর্মকে দেশগত