পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের ত্যাগ, স্বতঃউচ্ছসিত আনন্দের মধ্য থেকে উদূবেল হয়ে উঠছে না। সেইজন্যে তোমার সঙ্গে আমাদের মিল হচ্ছে না । আনন্দের টানে আপনি আমরা আনন্দস্বরাপের মধ্যে গিয়ে পৌছোতে পারছি নে, আমাদের ভক্তি তাই সহজ ভক্তি হয়ে উঠছে না । তোমার র্যারা ভক্ত র্তারাই আমাদের এই অনৈক্যের সেতুস্বরূপ হয়ে তোমার সঙ্গে আমাদের মিলিয়ে রেখে দেন, আমরা তোমার ভক্তদের ভিতর দিয়ে তোমাকে দেখতে পাই, তোমারই স্বরূপকে মানুষের ভিতর দিয়ে ঘরের মধ্যে লাভ করি। দেখি যে তঁরা কিছু চান না, কেবল আপনাকে দান করেন ; সে দান মঙ্গলের উৎস থেকে আপনিই উৎসারিত হয়, আনন্দের নির্বর থেকে আপনিই ঝরে পড়ে, তঁদের জীবন চার দিকে মঙ্গললোক সৃষ্টি করতে থাকে- সেই সৃষ্টি আনন্দের সৃষ্টি । এমনি করে তঁরা তোমার সঙ্গে মিলেছেন। তাদের জীবনে ক্লান্তি নেই, ভয় নেই, ক্ষতি নেই, কেবলই প্রাচুর্য, কেবলই পূর্ণতা । দুঃখ যখন তাদের আঘাত করে তখনো তারা দান করেন, সুখ যখন তাদের ঘিরে থাকে তখনো তারা বর্ষণ করেন। তঁদের মধ্যে মঙ্গলের এই রূপ যখন দেখতে পাই, আনন্দের এই প্ৰকাশ যখন উপলব্ধি করি, তখন, হে পরম মঙ্গল, পরমানন্দ, তোমাকে আমরা কাছে পাই ; তখন তোমাকে নিঃসংশয় সত্যরূপে বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে তেমন অসাধ্য হয় না । ভক্তের হৃদয়ের ভিতর দিয়ে তোমার যে মধুময় প্রকাশ, ভক্তের জীবনের উপর দিয়ে তোমার প্রসন্ন মুখের যে প্রতিফলিত স্নিগ্ধ রশ্মি, সেও তোমার জগদব্যাপী বিচিত্র আত্মদানের একটি বিশেষ ধারা ; ফুলের মধ্যে যেমন তোমার গন্ধ, ফলের মধ্যে যেমন তোমার রস, ভক্তের ভিতর দিয়েও তোমার আত্মদানকে আমরা যেন তেমনি আনন্দের সঙ্গে ভোগ করতে পারি। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এই ভক্তিসুধা-সরস তোমার অতিমধুর লাবণ্য যেন আমরা না দেখে চলে না। যাই । তোমার এই সৌন্দর্য তোমার কত ভক্তের জীবন থেকে কত রঙ নিয়ে যে মানবলোকের আনন্দকানন সাজিয়ে তুলেছে, তা যে দেখেছে সেই মুগ্ধ হয়েছে। অহংকারের অন্ধতা থেকে যেন এই দেবদুর্লভ দৃশ্য হতে বঞ্চিত না হই । যেখানে তোমার একজন ভক্তের হৃদয়ের প্ৰেমস্রোতে তোমার আনন্দধারা একদিন মিলেছিল, আমরা সেই পুণ্যসংগমের তীরে নিভৃত বনচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছি ; মিলন-সংগীত এখনো সেখানকার সূর্যোদয়ে সূর্যাস্তে, সেখানকার নিশীথরাত্রের নিস্তব্ধতায় বেজে উঠছে। থাকতে-থাকতে শুনতে-শুনতে সেই সংগীতে আমরাও যেন কিছু সুর মিলিয়ে যেতে পারি এই আশীর্বাদ করো। কেননা জগতে যত সুর বাজে তার মধ্যে এই সুরই সব চেয়ে গভীর-সব চেয়ে মিষ্ট। মিলনের আনন্দে মানুষের আত্মার এই গান, ভক্তিবীণায় এই তোমার অঙ্গুলির স্পর্শ, এই সোনার তারের মূৰ্ছিনা । . ৭ই পৌষ, রাত্রি ১৩১৬ চিরনবীনতা প্রভাত এসে প্রতিদিনই একটি রহস্যকে উদঘাটিত করে দেয় ; প্রতিদিনই সে একটি চিরন্তন কথা বলে, অথচ প্রতিদিন মনে হয় সে কথাটি নূতন । আমরা চিন্তা করতে করতে, কাজ করতে করতে, লড়াই করতে করতে প্ৰতিদিনই মনে করি, বহুকালের এই জগৎটা ক্লাস্তিতে অবসন্ন, ভাবনায় ভারাক্রান্ত এবং ধূলায় মলিন হয়ে পড়েছে। এমন সময় প্রত্যুষে প্রভাত এসে পূর্ব আকাশের প্রান্তে দাড়িয়ে স্মিতহাস্যে জাদুকরের মতো জগতের উপর থেকে অন্ধকারের ঢাকাটি আস্তে আস্তে খুলে দেয়। দেখি সমস্তই নবীন, যেন সৃজনকর্তা এই মুহূর্তেই জগৎকে প্রথম সৃষ্টি করলেন । এই যে প্রথমকালের এবং চিরকালের নবীনতা এ আর কিছুতেই শেষ হচ্ছে না, প্রভাত এই কথাই বলছে। আজ এই যে দিনটি দেখা দিল এ কি আজকের ? এ যে কোন যুগারম্ভে জ্যোতিবাষ্পের আবরণ ছিন্ন করে যাত্রা আরম্ভ করেছিল সে কি কেউ গণনায় আনতে পারে ? এ দিনের নিমেষহীন দৃষ্টির