পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዔ SWን রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রভাতে তীর একটি নির্মল মূর্তিকে দেখতে পাই- চেয়ে দেখি সেখানে ক্ষতির বলিরেখা কোথায় ? সমস্তই পূর্ণ হয়ে আছে। দেখি যে, বুদবুদ যখন কেটে যায় সমুদ্রের তখনাে কণামাত্র ক্ষয় হয় না। আমাদের চোখের উপরে যতই উলটাপালট হয়ে যাক-না। তবু দেখি যে, সমস্তই ধ্রুব হয়ে আছে, কিছুই নড়ে নি। আদিতে শিবম, অন্তে শিবম এবং অন্তরে শিবম। সমুদ্রের ঢেউ যখন চঞ্চল হয়ে ওঠে তখন সেই ঢেউদের কাণ্ড দেখে সমুদ্রকে আর মনে থাকে না। তারাই অসংখ্য, তারাই প্ৰকাণ্ড, তারাই প্ৰচণ্ড, এই কথাই কেবল মনে হতে থাকে। তেমনি সংসারের অনৈক্যকে বিরোধকেই সব চেয়ে প্রবল বলে মনে হয়। তা ছাড়া আর যে কিছু আছে তা কল্পনাতেও আসে না। কিন্তু প্ৰভাতের মুখে একটি মিলনের বার্তা আছে, যদি তা কান পেতে শুনি তবে শুনতে পাব- এই বিরোধ এই অনৈক্যই চরম নয়, চরম হচ্ছেন অদ্বৈতম। আমরা চােখের সামনে দেখতে পাই হানাহানির সীমা নেই, কিন্তু তার পরে দেখি ছিন্নবিচ্ছিন্নতার চিহ্ন কোথায় ? বিশ্বের মহাসেতু লেশমােত্রও টলে নি। গণনাহীন অনৈক্যাকে একই বিপুল ব্ৰহ্মাণ্ডে বেঁধে চিরদিন বসে আছেন সেই অদ্বৈতম, সেই একমাত্র এক। আদিতে অদ্বৈতম, অন্তে অদ্বৈতম, অন্তরে অদ্বৈতম। মানুষ যুগে যুগে প্রতিদিন প্ৰাতঃকালে দিনের আরম্ভে প্রভাতের প্রথম জাগ্ৰত আকাশ থেকে এই মন্ত্রটি অন্তরে বাহিরে শুনতে পেয়েছে— শান্তম শিবম অদ্বৈতম। একবার তার সমস্ত কর্মকে থামিয়ে দিয়ে, তার সমস্ত প্রবৃত্তিকে শান্ত করে নবীন আলোকের এই আকাশব্যাপী বাণীটি তাকে গ্ৰহণ করতে হয়েছে- শান্তম শিবম অদ্বৈতম। এমন হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রতিদিনই এই একই বাণী, তার কর্মারম্ভের এই একই দীক্ষামন্ত্র । আসল সত্য কথাটা হচ্ছে এই যে, যিনি প্রথম তিনি আজও প্রথম হয়েই আছেন। মুহূর্তে মুহূর্তেই তিনি সৃষ্টি করছেন, নিখিল জগৎ এইমাত্র প্রথম সৃষ্টি হল এ কথা বললে মিথ্যা বলা হয় না। জগৎ একদিন আরম্ভ হয়েছে, তার পরে তার প্রকাণ্ড ভার বহন করে তাকে কেবলই একটা সোজা পথে টেনে আনা হচ্ছে, এ কথা ঠিক নয়। জগৎকে কেউ বহন করছে না, জগৎকে কেবলই সৃষ্টি করা হচ্ছে। যিনি প্রথম, জগৎ তার কাছ থেকে নিমেষে নিমেষেই আরম্ভ হচ্ছে। সেই প্ৰথমের সংস্রব কোনোমতেই ঘুচিছে না। এইজনেই গোড়াতেও প্রথম, এখনো প্রথম ; গোড়াতেও নবীন, এখনাে নবীন। বিচৈতি চান্তে বিশ্বমাদীে- বিশ্বের আরম্ভেও তিনি, অন্তেও তিনি, সেই প্ৰথম, সেই নবীন, সেই নির্বিকার । এই সত্যটিকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের মুহূর্তে মুহূর্তে নবীন হতে হবে, আমাদের ফিরে ফিরে নিমেষে নিমেষে তার মধ্যে জন্মলাভ করতে হবে। কবিতা যেমন প্রত্যেক মাত্রায় মাত্রায় আপনার ছন্দটিতে গিয়ে পীেছােয়, প্রত্যেক মাত্রায় মাত্রায় মূল ছন্দটিকে নূতন করে স্বীকার করে, এবং সেইজনেই সমগ্রের সঙ্গে তার প্রত্যেক অংশের যোগ সুন্দর হয়ে ওঠে। আমাদেরও তাই করা চাই । আমরা প্রবৃত্তির পথে, স্বাতন্ত্র্যের পথে একেবারে একটানা চলে যাব তা হবে না ; আমাদের চিত্ত বারংবার সেই মূলে ফিরে আসবে; সেই মূলে ফিরে এসে তীর মধ্যে সমস্ত চরাচরের সঙ্গে আপনার যে অখণ্ড যোগ সেইটিকে বার বার অনুভব করে নেবে, তবেই সে মঙ্গল হবে, তবেই সে সুন্দর হবে। এ যদি না হয়, আমরা যদি মনে করি সকলের সঙ্গে যে যোগে আমাদের মঙ্গল, আমাদের স্থিতি, আমাদের সামঞ্জস্য, যে যোগ আমাদের অস্তিত্বের মূলে, তাকে ছাড়িয়ে নিজে অত্যন্ত উন্নত হয়ে ওঠবার আয়ােজন করব, নিজের স্বতন্ত্র্যকেই একেবারে নিত্য এবং উৎকট করে তোেলবার চেষ্টা করব, তবে তা কোনোমতেই সফল এবং স্থায়ী হতে পারবেই না। একটা মন্ত ভাঙাচোরার মধ্যে তার অবসান হতেই হবে । জগতে যত কিছু বিপ্লব, সে এমনি করেই হয়েছে। যখনই প্রতাপ এক জায়গায় পুঞ্জিত হয়েছে, যখনই বর্ণের কুলের ধােনর ক্ষমতার ভাগ-বিভাগ ভেদ-বিভেদ পরস্পরের মধ্যে ব্যবধানকে একেবারে দুর্লঙ্ঘ্য করে তুলেছে, তখনই সমাজে ঝড় উঠেছে। যিনি অদ্বৈতম, যিনি নিখিল জগতের সমস্ত বৈচিত্র্যকে একের সীমা লঙ্ঘন করতে দেন না, ঠাকে একাকী ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে জয়ী হতে পারবে এতবড়ো শক্তি কোন রাজার বা রাজ্যের আছে। কেননা সেই অদ্বৈতের সঙ্গে যোগেই শক্তি,