পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՀO রবীন্দ্র-রচনাবলী সংসারের সমস্ত আবরণকে ভেদ করে আজ একবার আত্মাকে দেখে- কত বড়ো একটি মিলনের মধ্যে সে নিমগ্ন হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে, সে কী নিবিড়, কী নিগৃঢ়, কী আনন্দময় ! কোনো ক্লান্তি নেই, জরা নেই, স্নানতা নেই। সেই মিলনেরই বাঁশি জগতের সমস্ত সংগীতে বেজে উঠছে, সেই মিলনেরই উৎসবসজ্জা সমস্ত আকাশে ব্যাপ্ত হয়েছে। এই জগৎজোড়া সৌন্দর্যের কেবল একটিমাত্র অর্থ আছে- তোমার সঙ্গে তার মিলন হয়েছে সেইজন্যেই এত শোভা, এত আয়োজন। এই সৌন্দর্যের সীমা নেই, এই আয়ােজনের ক্ষয় নেই, চিরযৌবন তুমি চিরযৌবন, চিরসুন্দরের বাহুপাশে তুমি চিরদিন বাধা, সংসারের সমস্ত পর্দা সরিয়ে ফেলে সমাপ্ত লোভ মোহ অহংকারের জঞ্জাল কাটিয়ে আজ একবার সেই চিরদিনের আনন্দের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করো, সত্য হােক তোমার জীবন তোমার জগৎ জ্যোতির্ময় হােক, অমৃতময় হােক । দেখো, আজ দেখো, তোমার গলায় কে পারিজাতের মালা নিজের হাতে পরিয়েছেন- কার প্রেমে তুমি সুন্দর, কার প্রেমে তোমার মৃত্যু নেই, কার প্রেমের গীেরবে তোমার চারি দিক থেকে তুচ্ছতার আবরণ কেবলই কেটে কেটে যাচ্ছে- কিছুতেই তোমাকে চিরদিনের মতো আবৃত আবদ্ধ করতে পারছে না। বিশ্বে তোমার বরণ হয়ে গেছে- প্রিয়তমের অনন্তমহল বাড়ির মধ্যে তুমি প্রবেশ করেছ, চারি দিকে দিকে-দিগন্তে দীপ জ্বলছে, সুরলোকের সপ্তঋষি এসেছেন তোমাকে আশীর্বাদ করতে । আজ তােমার কিসের সংকোচ। আজ তুমি নিজেকে জানাে, সেই জানার মধ্যে প্রফুল্প হয়ে ওঠে, পুলকিত হয়ে ওঠে। তোমারই আত্মার এই মহােৎসবসভায় স্বপ্নাবিষ্টের মতো এক ধারে পড়ে থেকে না, যেখানে তোমার অধিকারের সীমা নেই সেখানে ভিক্ষুকের মতো উদ্ধৃবৃত্তি কোরো না। হে অন্তরতর, আমাকে বড়ো করে জানাবার ইচ্ছা তুমি একেবারেই সব দিক থেকে ঘুচিয়ে দাও । তোমার সঙ্গে মিলিত করে আমার যে জানা সেই আমাকে জানাও । আমার মধ্যে তোমার যা প্ৰকাশ তাই কেবল সুন্দর, তাই কেবল মঙ্গল, তাই কেবল নিত্য। আর সমস্তের কেবল এইমাত্র মূল্য যে তারা সেই প্রকাশের উপকরণ। কিন্তু তা না হয়ে যদি তারা বাধা হয় তবে নির্মমভাবে তাদের চুর্ণ করে দাও । আমার ধন যদি তোমার ধন না হয় তবে দারিদ্র্যের দ্বারা আমাকে তোমার বুকের কাছে টেনে নাও, আমার বুদ্ধি যদি তোমার শুভবুদ্ধি না হয় তবে অপমানে তার গর্ব চূৰ্ণ করে তাকে সেই ধুলায় নত করে দাও যে ধূলার কোলে তোমার বিশ্বের সকল জীব বিশ্রাম লাভ করে। আমার মনে যেন এই আশা সর্বদাই জেগে থাকে যে, একেবারে দূরে তুমি আমাকে কখনােই যেতে দেবে না, ফিরে ফিরে তোমার মধ্যে আসতেই হবে, বারংবার তোমার মধ্যে নিজেকে নবীন করে নিতেই হবে । দাহ বেড়ে চলে, বোঝা ভারী হয়, ধুলা জমে ওঠে, কিন্তু এমন করে বরাবর চলে না, দিনের শেষে জননীর হাতে পড়তেই হয়, অনন্ত সুধাসমুদ্রে অবগাহন করতেই হয়, সমস্ত জুড়িয়ে যায়, সমস্ত হালকা হয়, ধুলার চিহ্ন থাকে না ; একেবারে তোমারই যা সেই গোড়াটুকুতেই গিয়ে পৌছোতে হয়, যা কিছু আমার সে সমস্ত জঞ্জাল ঘুচে যায়। মৃত্যুর আঁচলের মধ্যে ঢেকে তুমি একেবারে তােমার অবারিত হৃদয়ের উপরে আমাদের টেনে নাও। তখন কোনাে ব্যবধান রাখ না। তার পরে বিরাম-রাত্রির শেষে হাতে পাথেয় দিয়ে মুখচুম্বন করে হাসিমুখে জীবনের স্বাতন্ত্র্যের পথে আবার পাঠিয়ে দাও। নির্মল প্ৰভাতে প্ৰাণের আনন্দ উচ্ছসিত হয়ে ওঠে, গান করতে করতে বেরিয়ে পড়ি, মনে গর্ব হয়, বুঝি নিজের শক্তিতে নিজের সাহসে, নিজের পথেই দূরে চলে যাচ্ছি। কিন্তু প্রেমের টান তো ছিন্ন হয় না, শুষ্ক গর্বনিয়ে তো আত্মার ক্ষুধা মেটে না । শেষকালে নিজের শক্তির গীেরবে ধিক্কার জন্মে, সম্পূর্ণ বুঝতে পারি এই শক্তিকে যতক্ষণ তোমার মধ্যে না নিয়ে যাই ততক্ষণ এ কেবল দুর্বলতা। তখন গর্বকে বিসর্জন দিয়ে র সমান ক্ষেত্রে এসে দাড়াতে চাই। তখনই তোমাকে সকলের মাঝখানে পাই, কোথাও আর , কোনো বাধা থাকে না । সেইখানে এসে সকলের সঙ্গে একত্রে বসে যাই যেখানে-মধ্যে বামনমাসীনং বিশ্বে দেবা উপাসতে । শান্তম শিবমদ্বৈতম। এই মন্ত্র গভীর সুরে বাজুক সমস্ত মনের তারে, সমস্ত কর্মের ঝংকারে । বাজতে বাজতে একেবারে নীরব হয়ে যাক। শাস্তের মধ্যে, শিবের মধ্যে, একের মধ্যে, তোমার মধ্যে নীরব হয়ে যাক। পবিত্র হয়ে পরিপূর্ণ হয়ে সুধাময় হয়ে নীরব হয়ে যাক। সুখদুঃখ পূর্ণ