পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Գ ՀÇ আমরা যেন সম্পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি। এই কথাটি স্মরণ করে আমাদের বক্ষ যেন প্রশস্ত হয়, আমাদের চিত্ত যেন আশান্বিত হয়ে ওঠে। যে বােধ সকলের চেয়ে বড়ো সেই বিশ্ববোধ- যে লাভ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই ব্ৰহ্মলাভ কাল্পনিকতা নয় ; তারই সাধনা প্রচার করবার জন্যে এ দেশে মহাপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ব্ৰহ্মকেই সমস্তের মধ্যে উপলব্ধি করাটাকে তঁরা এমন একটি অত্যন্ত নিশ্চিত পদাৰ্থ বলে জেনেছেন যে জোরের সঙ্গে এই কথা বলেছেন ইহ চেৎ আবেদীৎ অথ। সত্যমস্তি ন চেৎ ইহ আবেদীৎ মহতী বিনষ্টিঃ । ভূতেষু ভূতেষু বিচিন্ত্য ধীরাঃ প্ৰেত্যাম্মিাল্লোেকাৎ অমৃত ভবান্তি । এঁকে যদি জানা গেল। তবেই সত্য হওয়া গেল, একে যদি না জানা গেল। তবেই মহাবিনাশ ভূতে ভূতে সকলের মধ্যেই তাকে চিন্তা করে ধীরেরা অমৃতত্ব লাভ করেন । ভারতবর্ষের এই মহৎ সাধনার উত্তরাধিকার যা আমরা লাভ করেছি। তাকে আমরা অন্য দেশের শিক্ষা ও দৃষ্টান্তে ছােটাে করে মিথ্যা করে তুলতে পারব না। এই মহৎ সত্যটিকেই নানা দিক দিয়ে উজ্জ্বল করে তোেলবার ভার আমাদের দেশের উপরেই আছে । আমাদের দেশের এই তপস্যাটিকেই বড়োরকম করে সার্থক করবার দিন আজ আমাদের এসেছে। জিগীষা নয়, জিঘাংসা নয়, প্ৰভুত্ব নয়, প্রবলতা নয়, বর্ণের সঙ্গে বর্ণের।-- ধর্মের সঙ্গে ধর্মের— সমাজের সঙ্গে সমাজের— স্বদেশের সঙ্গে বিদেশের ভেদ বিরোধ বিচ্ছেদ নয়, ছোটােবড়ো আত্মপর সকলের মধ্যেই উদারভাবে প্রবেশের যে সাধনা সেই সাধনাকেই আমরা আনন্দের সঙ্গে বরণ করব। আজ আমাদের দেশে কত ভিন্ন জাতি, কত ভিন্ন ধর্ম, কত ভিন্ন সম্প্রদায় তা কে গণনা করবে ? এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের কথায় কথায় পদে পদে যে ভেদ এবং আহারে বিহারে সর্ব বিষয়েই মানুষের প্রতি মানুষের ব্যবহারে যে নিষ্ঠুর অবজ্ঞা ও ঘূণা প্রকাশ পায় জগতের অন্য কোথাও তার আর তুলনা পাওয়া যায় না। এতে করে আমরা হারাচ্ছি তাকে যিনি সকলকে নিয়েই এক হয়ে আছেন— যিনি তার প্রকাশকে বিচিত্র করেছেন, কিন্তু বিরুদ্ধ করেন নি। তাকে হারানো মানেই হচ্ছে মঙ্গলকে হারানো, শক্তিকে হারানো, সামঞ্জস্যকে হারানো এবং সত্যকে হারানো । তাই আজ আমাদের মধ্যে দুৰ্গতির সীমা পরিসীমা নেই ; যা ভালো তা কেবলই বাধা পায়, পদে পদেই খণ্ডিত হতে থাকে, তার ক্রিয়া সর্বত্র ছড়াতে পায় না। সদনুষ্ঠান একজন মানুষের আশ্রয়ে মাথা তােলে এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়, কালে কালে পুরুষে পুরুষে তার অনুবৃত্তি থাকে না। দেশে যেটুকু কল্যাণের উদ্ভব হয় তা কেবলই পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মতাে টলমল করতে থাকে । তার কারণ আর কিছুই নয়— আমরা খাওয়া-শোওয়া ওঠা-বসায় য়ে সাত্ত্বিকতার সাধনা বিস্তার করেছিলুম তাই আজ লক্ষ্যহীন প্রাণহীন হয়ে বিকৃত হয়ে উঠেছে। তার যা উদ্দেশ্য ছিল ঠিক তারই বিপরীত কাজ করছে। যে বিশ্ববােধকে সে অবারিত করবে, তাকেই সে সকলের চেয়ে আবরিত করছে। দুই পা অন্তর এক-একটি প্রভেদকে সে সৃষ্টি করে তুলছে এবং মানবন্ধুণার কাঁটাগাছ দিয়ে অতি নিবিড় করে তার বেড়া নির্মাণ করছে। এমনি করেই ভূমাকে আমরা হারালুম, মনুষ্যত্বকে তার বৃহৎক্ষেত্রে দাঁড় করাতে আর পারলুম না, নিরর্থক কতকগুলি আচার মেনে চলাই আমাদের কর্ম হয়ে দাঁড়াল, শক্তিকে বিচিত্র পথে উদারভাবে প্রসারিত করা হল না, চিত্তের গতিবিধির পথ সংকীর্ণ হয়ে এল, আমাদের আশা ছােটাে হয়ে গেল, ভরসা রইল না, পরস্পরের পাশে এসে দাড়াবার কোনাে টান নেই, কেবলই তফাতে তফাতে সরে যাবার দিকেই তাড়না, কেবলই টুকরো টুকরো করে দেওয়া, কেবলই ভেঙে ভেঙে পড়—শ্ৰদ্ধা নেই, সাধনা নেই, শক্তি নেই, আনন্দ নেই। যে মাছ সমুদ্রের সে যদি অন্ধকার গুহার ক্ষুদ্র বদ্ধ জলের মধ্যে গিয়ে পড়ে তবে সে যেমন ক্রমে অন্ধ হয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে, তেমনি আমাদের যে আত্মার স্বাভাবিক বিহারক্ষেত্র হচ্ছে বিশ্ব, আনন্দলোক হচ্ছেন ডুমা, তাকে এই সমস্ত শত খণ্ডিত খাওয়া-ছােওয়ার ছােটাে ছােটাে গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে v প্রতিদিন তার বুদ্ধিকে অন্ধ, হৃদয়কে বন্দী এবং শক্তিকে পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে। নিতান্ত প্রত্যক্ষ এই