পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳV)\, রবীন্দ্র-রচনাবলী লেখন লেখন ১৩৩৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । এই গ্ৰন্থ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : লেখন যখন চীনে জাপানে গিয়েছিলেম প্ৰায় প্রতিদিনই স্বাক্ষরলিপির দাবি মেটাতে হত । কাগজে, রেশমের কাপড়ে, পাখায় অনেক লিখতে হয়েছে। সেখানে তারা আমার বাংলা লেখাই চেয়েছিল, কারণ বাংলাতে এক দিকে আমার, আবার আর-এক দিকে সমস্ত বাঙালি জাতিরই স্বাক্ষর। এমনি করে যখন-তখন পথে-ঘাটে যেখানে-সেখানে দু-চার লাইন কবিতা লেখা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এই লেখাতে আমি আনন্দও পেতুম | দু-চারটি বাক্যের মধ্যে এক-একটি ভাবকে নিবিষ্ট করে দিয়ে তার যে একটি বাহুল্যবর্জিত রূপ প্রকাশ পেত তা আমার কাছে বড়ো লেখার চেয়ে অনেক সময় আরো বেশি আদর পেয়েছে। আমার নিজের বিশ্বাস বড়ো বড়ো কবিতা পড়া আমাদের অভ্যাস বলেই কবিতার আয়তন কম হলে তাকে কবিতা বলে উপলব্ধি করতে আমাদের বাধে। অতিভোজনে যারা অভ্যস্ত, জঠরের সমস্ত জায়গাটা বোঝাই না হলে আহারের আনন্দ তাদের অসম্পূর্ণ থাকে ; আহার্যের শ্রেষ্ঠতা তাদের কাছে খাটাে হয়ে যায় আহারের পরিমাণ পরিমিত হওয়াতেই। আমাদের দেশে পাঠকদের মধ্যে আয়তনের উপাসক অনেক আছে- সাহিত্য সম্বন্ধেও তারা বলে, নাল্পে সুখমস্তি— নাট্য সম্বন্ধেও তারা রাত্রি তিনটে পর্যন্ত অভিনয় দেখার দ্বারা টিকিট কেনার সার্থকতা বিচার করে । জাপানে ছোটাে কাব্যের অমর্যাদা একেবারেই নেই। ছোটাের মধ্যে বড়োকে দেখতে পাওয়ার সাধনা তাদের— কেননা তারা জাত-আর্টিস্ট | সৌন্দৰ্য-বস্তুকে তারা গজের মাপে বা সেরের ওজনে হিসাব করবার কথা মনেই করতে পারে না । সেইজন্যে জাপানে যখন আমার কাছে কেউ কবিতা দাবি করেছে, দুটি-চারটি লাইন দিতে আমি কুষ্ঠিত হইনি। তার কিছুকাল পূর্বেই আমি যখন বাংলাদেশে গীতাঞ্জলি প্রভৃতি গান লিখছিলুম, তখন আমার অনেক পাঠকই লাইন গণনা করে আমার শক্তির কাপণ্যে হতাশ হয়েছিলেন- এখনো সে-দলের লোকের অভাব নেই | V এইরকম ছোটাে ছোটো লেখায় একবার আমার কলম যখন রস পেতে লাগল। তখন আমি অনুরোধনিরপেক্ষ হয়েও খাতা টেনে নিয়ে আপন মনে যা-তা লিখেছি এবং সেইসঙ্গে পাঠকদের মন ঠাণ্ড করবার জন্যে বিনয় করে বলেছি। : আমার লিখন ফুটে পথধারে ক্ষণিক কালের ফুলে, চলিতে চলিতে দেখে যারা তারে চলিতে চলিতে ভুলে। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে এটা ক্ষণিক কালের ফুলের দোষ নয়, চলতে চলতে দেখারই দোষ । যে-জিনিসটা বহরে বড়ো নয় তাকে আমরা দাঁড়িয়ে দেখি নে, যদি দেখতুম, তবে মেঠো ফুল দেখে খুশি হলেও লজ্জার কারণ থাকত না । তার চেয়ে কুমড়োফুল যে রূপে শ্রেষ্ঠ তা নাও হতে পারে । গেল বারে যখন ইটালিতে গিয়েছিলুম, তখন স্বাক্ষরলিপির খাতায় অনেক লিখতে হয়েছিল। লেখা যারা চেয়েছিলেন তাদের অনেকেরই ছিল ইংরেজি লেখারই দাবি । এবারেও লিখতে লেখা জমা হয়ে উঠল। এইরকম অনেক সময়ই অনুরোধের খাতিরে লেখা শুরু হয়, তার পরে ঝোক চেপে গেলে আর অনুরোধের দরকার থাকে না । জার্মানিতে গিয়ে দেখা গেল, এক উপায় বেরিয়েছে তাতে হাতের অক্ষর থেকেই ছাপানো