পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ(չo রবীন্দ্র-রচনাবলী যা-কিছু লিখেছি নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। গল্পে যা লিখেছি তার মূলে আছে আমার অভিজ্ঞতা, আমার নিজের দেখা । তাকে গীতধর্মী বললে ভুল করবে। কঙ্কাল কি “ক্ষুধিত পাষাণকে হয়তো খানিকটা বলতে পাের, কারণ সেখানে কল্পনার প্রাধান্য, কিন্তু তাও পুরোপুরি নয়। তোমরা আমার ভাষার কথা বল, বল যে গদ্যেও আমি কবি । আমার ভাষা যদি কখনো আমার গল্পাংশকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মূল্য পায়, সেজন্য আমাকে দোষ দিতে পার না । এর কারণ, বাংলা গদ্য আমার নিজেকেই গড়তে হয়েছে। ভাষা ছিল না, পর্বে পর্বে স্তরে স্তরে তৈরি করতে হয়েছে আমাকে । আমার প্রথম দিককার গদ্যে, যেমন “কাব্যের উপেক্ষিতা”, “কেক ধ্বনি”, এ-সব প্রবন্ধে, পদ্যের ঝোক খুব বেশি ছিল, ও-সব যেন অনেকটা গদ্য-পদ্য গোছের । গদ্যের ভাষা গড়তে হয়েছে আমার গল্পপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে । মোপাসার মতো যে-সব বিদেশী লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বল, তারা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন । লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে হলে তাদের কী দশা হত। জানি নে । ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে আমি যে ছোটাে ছোটাে গল্পগুলো লিখেছি, বাঙালি সমাজের বাস্তবজীবনের ছবি তাতেই প্রথম ধরা পড়ে। বঙ্কিম যে দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা লিখেছিলেন, সে-সব কি সত্যি ছিল ? সে-সব romantic situation কি তখন ঘটতে পারত ? সত্যি হচ্ছে এই যে, তিনি পড়েছিলেন ইংরেজি রোমান্স, পড়ে ভালো লেগেছিল। তৃপ্তির একটা ক্ষেত্র তাে চাই। বঙ্কিম পেয়েছিলেন সে ক্ষেত্র, আমাদের দিয়েছিলেন। আমি তাই বলি, বঙ্কিমের রচনায় আমরা যা পাই তা সামন্ততন্ত্র নয়। তাকে নতুন একটা পিপাসা বলতে পার, যা মেটাবার রস তিনি যেখান থেকে হােক সংগ্রহ করেছিলেন । তার বইগুলোতে যে-সব কাণ্ডকারখানা আছে, সেগুলো তীর স্মৃতির মধ্যেও ছিল না। আর মজা এই, আমাদের তা ভালোও লেগেছে, কারণ এ স্বাদ আমরা আগে কখনো পাই নি । নিন্দে করতে পারব না। বঙ্কিমকে, নিশ্চয়ই বলব তিনি ও-রসের জোগান দিয়েছিলেন বলেই বেঁচে গিয়েছিলুম। কী dull সমাজ ছিল তখন । তারই মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি এ-সব রাজার লড়াই ইত্যাদি আমাদের গরিবের মনে একটা উন্মাদনা এনে দিয়েছিল । বিদেশ থেকে আমদানি বলে একে আমি ছোটো করছি না । এতে সন্দেহ নেই যে ইংরেজ ওদের যে-সাহিত্য আমাদের দেশে আনলে, তা আমাদের চিত্তবৃত্তিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। তবে এও সত্য যে বাংলাদেশে ক্ষেত্ৰও । প্ৰস্তুত ছিল— আমাদের মনটাই সাহিত্যিক। য়ুরোপীয় কালচার ঠিক জায়গা পেয়েছিল আমাদের মধ্যে | সোনার ফসল ফলল। ইংরেজ আসার দরুন নয়, আমরা ওদের সাহিত্য পেয়েছিলুম বলে। ইংরেজ না হয়ে ফরাসি যদি হত আজ আমরা সব মোপাসঁা হয়ে উঠাতুম। আমরা ব্যাকুল হয়ে ছিলুম, তাই পাওয়ামাত্র আগ্রহভরে নিয়েছি। ! বঙ্কিমের গল্প এখন হয়তো তোমাদের কাছে আজগুবি ঠেকে, কিন্তু আমরা তাতে যে নতুন রস পেয়েছিলুম, তা ভুলতে পারি নে। এখন তোমরা বল তোমাদের সমাজেই সব আছে, গল্পের সব উপাদানই পাও তা থেকে । কিন্তু এখনকার সুখ দুঃখ ভালোবাসা কি তখন ছিল না ? তখনো ছিল, চোখে পড়ে নি। আবরণ রচনা করেছিল বিদেশী রোমান্স ||- —বুদ্ধদেব বসুর সহিত আলোচনার অনুলিপি ** s8 (N s8 - আমি একদা যখন বাংলাদেশের নদী বেয়ে তার প্রাণের লীলা অনুভব করেছিলুম তখন আমার অন্তরাত্মা আপন আনন্দে সেই সকল সুখদুঃখের বিচিত্র আভাস অন্তঃকরণের মধ্যে সংগ্ৰহ ১৬ দ্রষ্টব্য : “সাহিত্য, গান, ছবি”, প্রবাসী, আষাঢ় ১৩৪৮