পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মাধৰীকঙ্কণ বাল্যকালে বীরেন্দ্র, নবকুমার মিত্র নামক একটী দরিদ্রপত্রের সহিত একত্রে পাঠশালায় পাঠ করিতেন। নবকুমার অতিশয় সশীল ও নম, ও সব্বদাই তেজস্বী বীরেন্দ্রের বশবদ হইয়া থাকিত, সতরাং তাহার প্রতি বীরেন্দ্রের স্নেহ জন্মাইয়াছিল। যৌবনকালে যখন বীরেন্দ্র জমীদারী স্থাপন করিলেন, নবকুমারকে ডাকাইয়া আপনার অমাত্য ও দেওয়ানপদে নিযুক্ত করিলেন। নবকুমার অতিশয় বৃদ্ধিমান ও সচেতুর, সশঙ্খিলরপে কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিতে লাগিলেন। নবকুমার বার্থপর হইলেও নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, বীরেন্দ্রের নিকট ভিক্ষা করিয়া দই পাঁচখানি গ্রাম আপনার নামে করিলেন, কিন্তু ভয়ে হউক, কৃতজ্ঞতাবশতঃ হউক, বীরেন্দ্রের জমীদারীর কোনও হানি করেন নাই। বীরেন্দ্রের মৃত্যুর সময় নরেন অতি শিশু, জমীদারী ও পত্রের ভার প্রিয় সহদের হস্তে ন্যস্ত করিয়া বীরেন্দ্র মানবলীলা সম্বরণ করিলেন। ভালবাসা যতদরে নাবে ততদর উঠে না। অপত্যস্নেহের ন্যায় পিতৃস্নেহ বা মাতৃস্নেহ কুয়া না গেল তলত বল ও ক্ষণভঙ্গরে। নবকুমারের কৃতজ্ঞতা শীঘ্র ভাঙ্গিয়া গেল । নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, কিন্তু নবকুমার দরিদ্র, ঘটনাস্রোতে সমস্ত জমীদারী প্রাপ্তির আশা তাঁহার হৃদয়ে জাগরিত হইল। সে লোভ দরিদ্রের পক্ষে দন্দেমনীয়। বীরেন্দ্রের করে এরপে জ্ঞাতি কুটুম্বব কেহ ছিল না, দুই একজন যাঁহারা ছিলেন তাঁহারাও নবকুমারের সহিত যোগ দিলেন। সংসারে যাঁহারা বীরেন্দ্রের অভিভাবক ছিলেন, তাঁহারা কিছুই জানিলেন না, অথবা জানিয়া কি করিবেন ? তথাপি নবকুমার সমস্ত জমীদারী একাকী লইবেন প্রথমে এরপে উদ্দেশ্য ছিল না। বীরেন্দ্রের জীবদ্দশায়ই দুই পাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিয়াছিলেন, এখন আরও দুই পাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিতে লাগিলেন। ক্রমে লোভ বাড়িতে লাগিল। ভাবিলেন, আমার একমাত্র কন্যা হেমের সহিত নরেন্দ্রের বিবাহ দিব, অবশেষে বীরেন্দ্রের জমীদারী তাঁহার পুত্রেরই হইবে। এখন নাবালকের নামে জমীদারী থাকিলে গোলমাল হইতে পারে, সম্প্রতি আপন নামে থাকাতে বোধ হয় কোন আপত্তি হইতে পারে না। এই প্রকার চিন্তা করিয়া তদনুসারে কার্য্য করিতে লাগিলেন। তৎকালে সবাদারের সভাতে প্রধান প্রধান জমীদার ও জায়গীরদারদিগের এক এক জন উকীল থাকিত। তাহারা নিজ নিজ মনিবের পক্ষ হইতে মধ্যে মধ্যে নজর দিয়া সবাদারের মন তুলট রাখিত, ও মানবের পক্ষ হইতে আবেদন আদি সমস্ত কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিত। সদরে এইরপে একটী একটী উকীল না থাকিলে জমীদারীর বিশেষ অনিকট হইবার সম্ভাবনা ছিল, এমন কি, জমীদারী হস্তান্তর হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। বীরনগর জমাদারীর উকীল এক্ষণে নবকুমারের বেতনভোগী। বঙ্গদেশের কানঙ্গ মহাশয়ের নিকট আবেদন করিলেন যে, বীরেন্দ্রের মৃত্যু হইতে সে জমীদারীর খাজনা নিয়মিতরে আসিতেছে না, তবে নবকুমার নামে একজন কাৰ্য্যদক্ষ লোক সেই জমীদারীর ভার লইয়া আপন ঘর হইতে যথাসময়ে খাজনা দিতেছে। নবকুমার বীরেন্দ্রের বিশেষ আত্মীয় ও বীরেন্দ্রের সমস্ত পরিবারকে প্রতিপালন করিতেছে। এই আবেদনসহ পঞ্চ সহস্র মদ্রা কানঙ্গ মহাশয়ের নিকট উপঢৌকন গেল। আবেদনের বিরুদ্ধে কেহ বলিবার ছিল না, তৎক্ষণাৎ বীরেন্দ্রের নাম খারিজ হইয়া নবকুমারের নাম লিখিত হইল। অদ্য নবকুমার মিত্র বীরনগরের জমীদার ! জমণীদারের হৃদয়ে নতেন নতন ভাবের আবিভাব হইতে লাগিল। যে নরেন্দ্রের পিতাকে পবোঁ পাজা করিতেন, যে নরেন্দ্রকে এতদিন অতি যত্নে পালন করিয়াছিলেন, আদ্য সেই নরেন্দ্র তাঁহার চক্ষর শলে হইল। নবকুমারের সাক্ষাতে না হউক অসাক্ষাতে সকলেই বলিত, "নরেন্দ্রের বাপের জমাদারী”, “নবকুমারের জমাদারী” কেহ বলিত না। গ্রামের প্রজারাও নরেন্দ্রকে দেখিয়া জমীদারপত্র বলিত, প্রকৃত জমাদার নবকুমার কি এ সমস্ত সহ্য করিতে পারেন ? তিনি চিন্তা করিতেন—আমি কি অপবাদ বহন করিবার জন্যই এই জমীদারী করিলাম? পুনরায় নরেন্দুের সহিত বিবাহ হইলে কে না বলিবে পিতার জমণীদারী পত্রে পাইল, আমার নাম কোথায় থাকে ? এতটা করিয়া কি পরিণামে এই ঘটিবে ? আমি কি জমীদার হইয়াও বালকের দেওয়ান বলিয়া পরিগণিত হইব ? কায্যেও কি তাহাই করিব, সযত্নে জমীদারী রক্ষা করিয়া পরে নরেন্দ্রকে げ○。