পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশচন্দ্র দত্ত ঃ জীবন-কথা ভূমিকা : ভারতবর্ষের ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দী একটি গৌরবময় যুগ। এই শতাব্দীতে পরাধীনতা সত্ত্বেও ভারতবষে বহন মনীষী, ধৰ্ম্মম ও সমাজ-সংস্কারক, রাজনীতিজ্ঞ ও সাহিত্য সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। যাঁহারা আধুনিক কালের ভারত-ইতিহাসের সঙ্গে কিঞ্চিলমাত্রও পরিচিত তাঁহারা এই সকল যুগস্রস্টা সমাজনেতাদের কায্যকলাপের কথা অবগত আছেন। রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ গত শতাব্দীর যুগস্রস্টাদের পুরোধা। রমেশচন্দ্র দত্ত এই যুগস্রস্টা মনীষিগণের সমপৰ্য্যায়ের না হইলেও নিজ কৃতিবলে ভারতমাতার সংসস্তান বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। রমেশচন্দ্রের জীবনকাল গত শতাব্দীর শেষাদ্ধব্যাপী; বত্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকেও তাহা উপচাইয়া পড়িয়াছে। এই ষাট বৎসরের ভিতর বাঙ্গালা তথা ভারতে এক অভূতপৃব্ব রেণেসীস বা নবজাগরণের সচেনা ও কথঞ্চিৎ পরিণতি ঘটিয়াছে। এই রেণেসসি বা নবজাগরণে যাঁহারা ভূরিপরিমাণ রসদ যোগাইয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে রমেশচন্দ্র দত্তের নাম স্বতঃই আমাদের মনে আসে । তাঁহার জীবনকথা এখানে সংক্ষেপে বিবত করিব। জন্ম ও বংশ পরিচয় : রমেশচন্দ্র ১৮৪৮ সনের ১৩ই আগস্ট কলিকাতা রামবাগানের বিখ্যাত দত্তপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি বা নীল দত্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই তিনি ইংরেজী নবীশ, বলিয়া খ্যাতিলাভ করেন। নীলমণির তিন পত্র : রসময়, হরিশ ও পীতাম্বর। পীতাম্ববরের জ্যেষ্ঠপত্র ঈশানচন্দ্র। রমেশচন্দ্র ঈশানচন্দ্রের মধ্যমপত্র। রমেশচন্দ্রের জ্যেষ্ঠপিতামহ রসময় দত্ত সে যুগের একজন বিদগ্ধ গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতিমলেক প্রতিষ্ঠানের সহিত তাঁহার ঘনিষ্ঠ যোগ স্থাপিত হইয়াছিল। গত শতাব্দীতে এই পরিবারে কয়েকজন কবি ও সাহিত্যিকেরও আবিভাল হয়। রসময় দত্তের পত্র কৈলাসচন্দ্র দত্ত “হিন্দ পাইয়োনীয়ার” নামক একখানি ইংরেজী পত্রিকা সম্পাদনা করিতেন। তাঁহার দ্বিতীয় পত্র গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ইংরেজী কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সবিখ্যাত কবি অর ও তরু দত্ত এই গোবিন্দচন্দ্রেরই কন্যা। রমেশচন্দ্রের খল্লতাত শশীচন্দ্র দত্ত-ও সে যুগে ইংরেজী লেখক বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইহারা প্রত্যেকেই ইংরেজী ভাষায় লিখিতেন বলিয়া সব্বসাধারণে তেমন পরিচিত হইতে পারেন নাই। রমেশচন্দ্রের পিতা ঈশানচন্দ্র ছিলেন একজন খ্যাতনামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। রাজকাৰ্য্যহেতু ঈশানচন্দ্রকে প্রায়ই স্থানান্তরে বদলি হইতে হইত। এজন্য রমেশচন্দ্রের বয়োবদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাকে জ্যেষ্ঠভ্রাতা যোগেশচন্দ্রের সঙ্গে কলিকাতার বাটীতে শিক্ষালাভের নিমিত্ত রাখা হইয়াছিল। ছাত্রজীবন : বিবাহ : রমেশচন্দ্র কলিকাতায় আসিয়া রীতিমত পাঠাভ্যাসে মন দেন। তিনি কলটোলা ব্রাশ্চ স্কুলে (বৰ্ত্তমান হেয়ার স্কুল) ভত্তি হইলেন। রমেশচন্দ্রের মাতা ১৮৫৯ সনে ইহধাম ত্যাগ করেন। ইহার দুই বৎসর পরে ১৮৬১ সনে পিতা ঈশানচন্দ্রও খলনায় মারা যান। অতঃপর রমেশচন্দ্রের তত্ত্বাবধানের ভার পড়িল খল্লতাত শশীচন্দ্রের উপর। রমেশচন্দ্র উৎকৃষ্ট ছাত্র ছিলেন । তিনি ১৮৬৪ সনে এনট্রান্স ও ১৮৬৬ সনে প্রেসিডেন্সী কলেজ হইতে এফ.এ. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সহিত উত্তীণ হইয়া যথাক্রমে সেকেন্ডগ্রেড জনিয়র স্কলারশিপ ও সিনিয়র সকলারশিপ প্রাপ্ত হন। এনট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে ১৮৬৪ সনে কলিকাতা সিমলিয়া নিবাসী নবগোপাল বসর মধ্যমা কন্যা মাতঙ্গিনী ওরফে মোহিনী বসজোর সঙ্গে রমেশচন্দ্রের বিবাহ হয়। এফ. এ. পরীক্ষায় উত্তীণ হইয়া রমেশচন্দ্র প্রেসিডেন্সী কলেজেই বি. এ. পড়িতে আরম্ভ করেন। এখানে এক বৎসর যথারীতি অধ্যয়নান্তর চতুর্থ বাষিক শ্রেণীতে উন্নীত হন। কিন্তু এই সময়েই তাঁহার জীবনের ভবিষ্যৎ গতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ঘটিল। তিনি ছাত্রাবস্থায়ই কিরাপ উচ্চ আশা পোষণ করিতেন তাহা অলপকাল মধ্যেই প্রকটিত হইল। সে যুগে ভারতবাসীদের মধ্যে একজনমাত্র (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সিবিল সাব্বিাস পরীক্ষায় উত্তীণ হইয়াছিলেন। তিন-তিনবার চেষ্টা করিয়াও পরবত্তী কালের সুবিখ্যাত ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ এই পরীক্ষায় উত্তীণ হইতে পারেন নাই। বলা বাহুল্য সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃতকাৰ্য্যতায়ই পরবত্তী কালে এই পরীক্ষার পথ ভারতবাসীদের পক্ষে অধিকতর কণ্টকিত করা হইয়াছিল।