পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজমহলের প্রাসাঙ্গ মত্তে ইন্দ্রপরী ছিল ও দিবারাত্র আনন্দলহরীতে ভাসিত, তিনি মৃত্যুকালে মস্তক রাখিবার স্থান পাইলেন না, বিদেশে শত্র হস্তে সবংশে বিনষ্ট হইলেন। 劇 দারা শ্যামনগর অথবা ফতে আবাদের যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিন্ধাদেশে পলায়ন করিয়াছিলেন, আরংজীবের সৈন্য তথা হইতে দারাকে দিল্লী লইয়া আইসে। নশংস সমাট জ্যোঠকে যথেস্ট অপমান করিয়া পরে হত্যা করেন। কারারুদ্ধ মোরাদও অচিরাং রাজাজ্ঞায় হত হইলেন। ভ্রাতৃরক্তে স্নাত হইয়া আরংজীব ভারতবর্ষের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করিলেন! যে দিন মথুরায় হেমের সহিত নরেন্দ্রের সাক্ষাৎ হইয়াছিল তাহার পর নরেন্দ্র নিরদেশ হইলেন। হেমলতা বঙ্গদেশে প্রত্যাবত্তন করিয়া নরেন্দ্রের অনেক অনুসন্ধান করাইলেন, মহানুভব শ্রীশচন্দ্র দেশে দেশে সংবাদ পাঠাইলেন যে, নরেন্দ্র ফিরিয়া আসিলেই তাঁহাকে তাঁহার পৈত্রিক জমীদারীর অদ্ধ অংশ ছাড়িয়া দিবেন, কিন্তু সেই দিনের পর নরেন্দ্রকে আর কেহ কোথাও দেখিতে পাইল না। হেমলতা বীরনগরে শ্রীশচন্দ্রের সহিত বাস করিতে লাগিলেন, মথুরা-মন্দিরে যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন হেম তাহা বিস্মত হয়েন নাই। পতিসেবায় ধম্মপরায়ণা হেমের অন্য চিন্তা তিরোহিত হইল, পতিভক্তি ভিন্ন অন্য ধৰ্ম্মম তিনি জানিতেন না। ক্রমে শ্রীশচন্দ্রের ঔরসে তাঁহার হেমন্তকুমারী ও সরযবালা নামক দুইটী কন্যা ও প্রতাপ নামে একটী পত্র জন্মিল। বিংশতি বৎসর পাবে শ্ৰীশ, নরেন্দ্র ও হেমলতা যেরপে সায়ংকালে গঙ্গাতীরে খেলা করিত, বাম্পোৎফুল্ললোচনে হেমলতা দেখিলেন, তাঁহার পত্রকন্যগণ সেইস্থানে সেইরাপ খেলা করিতেছে, দৌড়াদৌড়ি করিতেছে, আনন্দধবনিতে চারিদিকের কুঞ্জবন প্রতিধৰনিত হইতেছে। সংসারের এই গতি, একদল যাইতেছে, অন্য দল আসিতেছে! শিশুদিগের ললাট পরিকার, নয়ন উজদল, মুখমণ্ডল চিন্তাশন্যে, এখনও মানবজীবনের চিন্তায় সবগীয় অবয়ব অঙ্কিত হয় নাই। হেমলতার বিবাহের প্রায় দশ বৎসর পর হেমলতা পত্রিকন্যাগুলিকে লইয়া একটী সন্ন্যাসীর আবাস দেখিতে গেলেন। বীরনগর হইতে কয়েক ক্রোশ দরে একটী প্রসিদ্ধ শিমল ব্যক্ষ ছিল। শিমল বক্ষের গুড়ি হইতে প্রায়ই তিন দিকে তিনটী দেওয়ালের মত পাট বাহির হয়, এই বক্ষের সেই পাটগুলি এত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল, দেখিলে বোধ হয় যেন একটী উন্নত ঘর হইয়াছে। সেই অপরাপ ঘরে একজন সন্ন্যাসী কয়েক বৎসর অবধি বাস করিতেছিলেন। পল্লীগ্রামস্থ গহিণী ও বালিকাগণ সস্নেহে সেই সন্ন্যাসীকে প্রত্যহ দুগ্ধ ফলমল আনিয়া দিত, তাহাতেই তিনি জীবনধারণ করিতেন। সমস্ত দিন তিনি প্রায় ধ্যানে রত থাকিতেন, সায়ংকালে দবেলিকে সাহায্য করা, মানবের কতট নিবারণ করা, তাঁহার জীবনের কায্য। গভীর রজনী পৰ্য্যন্ত এই কাৰ্য্য করিয়া আবার তিনি সেই তরুগহে ফিরিয়া আসিতেন, তথায় ঘাসের উপর কি শীত, কি গ্রীম, কি বর্ষা, সকল কালেই তিনি সমভাবে নিদ্রা যাইতেন। সেই তরগাহ ও সেই সন্ন্যাসীকে দেখিবার জন্য অনেক দেশ হইতে অনেক লোক আসিত। হেমলতা বক্ষের কিঞ্চিৎ দরে নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন, ধীরে ধীরে পদব্রজে তরর নিকট যাইয়া সন্ন্যাসীকে উপলক্ষ করিয়া একটী প্রণাম করিলেন। পরে আপন শিশু পত্রটীকে ক্রোড়ে লইয়া দন্ডায়মান হইয়া সেই সন্ন্যাসীর দিকে দেখিতে লাগিলেন। সে দিক হইতে আর নয়ন ফিরাইতে পারিলেন না, নিসপন্দভাবে দেখিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসীও হেমলতার দিকে স্থিরদটিতে চাহিতেছিলেন। তিনি প্রীত নয়নে হেমলতাকে প্রণাম করিতে দেখিলেন, সতৃষ্ণ নয়নে হেমলতার কমনীয় কন্যা পত্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন । বোধ হইল যেন দেখিতে দেখিতে সন্ন্যাসীর হৃদয় একবার আলোড়িত হইল, বোধ হইল চক্ষন একবিন্দ জলে আপ্লত হইল! অবশেষে সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে হেমের নিকটে আসিয়া শিশুদিগের মাথায় হাত দিয়া আশীব্বাদ করিলেন। পরে হেমলতার দিকে স্থিরদটিতে অবলোকন করিয়া বলিলেন,—আমি আশীব্বাদ করিতেছি, তোমার দেবতুল্য স্বামীতে যেন তোমার অচলা ভক্তি থাকে, জন্মে মরণে যেন চিরপতিব্ৰতা হইয়া থাক। šāk সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন । তাহার পর আর কেহ সে তরতলে সন্ন্যাসীকেদেখিতে পাইল না, সন্ন্যাসী সে গ্রাম হইতে কোথায় চলিয়া গেলেন কেই আর জানিতে পারিল না। 。60