পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৩৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী বিলেত কোথায়, সেই যে গঙ্গাসাগরের গল্প শনি, তারও নাকি পার যেতে হয় ? শুনেছি নাকি নঙ্কায় যেতে হয়। বিন্দ। হ্যালো, কত সাগর পার হয়ে তবে বিলেত যায়। শুনেছি লঙ্কা পেরিয়েও অনেকদরে যায়। স-প। ও বাবা, সে গঙ্গাসাগরের যে ঢেউ শুনেছি, তাতে কি আর মানুষ বাঁচে ? তা নঙ্কা থেকে কি আর মানুষ ফিরে আসে, তারা রাক্কস হয়ে আসে শনেছি, শুনেছি তারা জেস্ত মানুষের গলায় ছরি দেয়। না বাবা, তোমাদের বিলেত গিয়েও কাজ নেই, কলকেতা গিয়েও কাজ নেই, তোমরা ঘরের নক্ষণী ঘরে থাক। তবে এখন আমি আসি দিদি। বিন্দ দুধ জনাল দিতে দিতে হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “এস বোন।” স-প। আর দৈখানি কেমন হয়েছে খেয়ে বলো। আর সন্ধাদিদি কি বলে, বলো। বিন্দ। বলব দিদি, বলব। সনাতন-গহিণী কয়েক পা গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আর দেখ দিদি, গরিবের কথাটা যেন মনে থাকে। কোথায় কলকেতায় যাবে ? ঘরের নক্ষী ঘর আলো করে থাক।" বিন্দ। তা দেখা যাবে। আমাদের যাবার এখন কিছুই ঠিক নেই; যদি যাওয়া হয়, তবে অলপ দিনের জন্যে, আবার ধান কাটার সময় আসব। গ্রাম ছেড়ে আমরা কোথায় থাকব ? কৈবত্ত-বধ কতক পরিমাণে সন্তুষ্ট হইয়া তখন ধীরে ধীরে গাহাভিমুখে গেলেন। সনাতন অদ্য প্রাতঃকালে উঠিয়া বিস্তীর্ণ শয্যায় পাশ্বশায়িনী নাই দেখিয়া, কিছু বিস্মিত হইয়াছিল। বিরহ-বেদনায় ব্যথিত হইয়াছিল কি অদ্য প্রাতঃকালেই মখনাড়া খাইতে হয় নাই বলিয়া আপনাকে ভাগ্যবান মনে করিতেছিল, তাহা আমরা ঠিক জানি না। কিন্তু সেই দুঃখ বা সুখ জগতের অধিকাংশ সংখদঃখের ন্যায় ক্ষণকাল স্থায়ী মাত্র। প্রথম সৰ্য্যোলোকে গহিণীর বিশাল ছায়া প্রাঙ্গণে পতিত হইল, গহিণীর কন্ঠস্বরে সনাতন শিহরিয়া উঠিল। সেই দিন বেলা দ্বিপ্রহরের সময় বিন্দর প্রতিবেশিনী হরিমতি নামে একটী বাদ্ধা গোয়ালিনী ও তাহার বিধবা পত্রবধ বিন্দকে দেখিতে আসিল । হরিমতির পত্র জীবিত তাহার দন্ধ বেচিয়া স্বচ্ছন্দে সংসার নির্বাহ হইত। পত্রের মৃত্যুর পর হরিমতি শিশু পত্রবধকে লইয়া সে জমাজমি দেখিতে পারিল না, অন্য কাহাকে কোরফা জমা দিল, যাহা খাজনা পাইল, সে অতি সামান্য । গরগুলি একে একে বিক্রয় হইল ; এক্ষণে দুই একটী আছে মাত্র, তাহার দন্ধ বিক্রয় করিয়া উদরপত্তি হয় না। শাশুড়ী ও পত্রবধ সব্বদাই বিন্দর বাড়ীতে আসিত ও বিন্দর ছেলেদের ব্যারামের সময় যথাসাধ্য সংসারের কাজ করিয়া দিত। বিন্দর এরপে অবস্থা নহে যে, তাহাদিগকে বিশেষ সাহায্য করিতে পারেন, তথাপি বৎসরের ফসল পাইলে প্রতিবেশিনীকে কিছু ধান্য পাঠাইয়া দিতেন, শীতের সময় দুই একখানি কাপড় কিনিয়া দিতেন, বাদ্ধার অসুখ করিলে কখন সার, কখন মিছরী, কখন দুই একটী সামান্য ঔষধি পাঠাইয়া দিতেন এবং সব্বদা বাদ্ধার তত্ত্ব লইতেন । দরিদ্রা এই সামান্য উপকারে এবং সকল বিপদআপদেই বিন্দর স্নেহের আশ্বাসবাক্যে অতিশয় আপ্যায়িত হইত এবং বিন্দকে বড়ই ভালবাসিত। বিন্দ গ্রাম ছাড়িয়া কলিকাতায় যাইবে শুনিয়া আজ আসিয়া অনেক কান্নাকাটি করিল। বিন্দ তাহাকে সান্তুনা করিয়া এবং তাহার পত্রবধকে একখানি পরাতন শাড়ী দিয়া ঘরে পাঠাইলেন। হরিমতি প্রস্থান করিলে তাঁতিদের একটী বোঁ বিন্দর সহিত দেখা করিতে আসিল। তাঁতিবোঁ দেখিতে কালো, এবং অতিশয় কাহিল, সে কাজকম করিতে পারিত না, সেজন্য শ্বাশুড়ীর নিকট সব্বদাই গালি খাইত। তাহার স্বামী তাহাকে ভালবাসিত না । গত শীতকালে তাহার পিঠে বেদনা হইয়াছিল, ঘাট থেকে জল আনিতে পারিত না, তজজন্য তাহার শ্বাশুড়ী তাহাকে প্রহার করিয়াছিল। তাঁতি-বোঁ কাহার কাছে যাবে ? কাঁদিতে কাঁদিতে বিন্দর কাছে আসিয়াছিল। বিন্দর এমন অর্থ নাই যে, তাঁতি-বোঁকে ঔষধি কিনিয়া দেন, তবে বাড়ীতে কেরোসিন তৈল ছিল, প্রত্যহ তাঁতি-বোঁকে রৌদ্রে বসাইয়া নিজে মালিস করিয়া দিতেন। চারি পাঁচ দিনের মধ্যে বেদনা আরাম হইয়া গেল, সেই অবধি তাঁতি-বোঁ গহকাযে অবসর পাইলেই বিন্দু-মাকে দেখিতে আসিতে বড় ভালবাসিত । ○○ 。