পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী প্ৰফীত হইয়া কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতে লাগিল; গ্রাম্য সন্দেরীরাও আনন্দে কল কল শব্দে গল্প আরম্ভ করিল। গলে্পর মধ্যে অল্পবয়স্কারা স্বামীর কথা ও প্রাচীনারা পরনিন্দার কথা আনিল। সরলা ও অমলা কলসে জল লইয়া নিজ নিজ গহে আসিল। অমলার স্বামীর সহিত পাঠক আগ্ৰেই পরিচিত হইয়াছেন। নবীন দাস জাতিতে কৈবত্ত, সে গ্রামের একজন মহাজন ছিল, ও অনেক প্রকার ব্যবসাও করিত। তাহার স্বভাব অতি শাস্ত ও সরল। তাহার কিঞ্চিৎ পরিমাণে সঙ্গতিও ছিল। প্রায় একশত বিঘা জমি, ২০ ২৫টা গরম, ৪ । ৫ খানা লাঙ্গল ও বাটীর মধ্যে আট-দশটা গোলা ছিল। আর লোকের মখে এমনও শনা ষাইত যে, নগদ কিছয় টাকা মাটীতে পতিয়া রাখিয়াছিল। ইহা ভিন্ন আপন পত্নীকে অনেক গহনাও দিয়াছিল। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর মৃত্যুর পর প্রায় ৩৫ বৎসর বয়সের সময় দশমবষীরা অমলাকে বিবাহ করে। এখনও বদ্ধ হয় নাই, কিন্তু অমলা উপহাস করিয়া তাহাকে “বদ্ধ স্বামী" বলিয়াই ডাকিত। অমলা স্নেহবতী ভাৰ্য্যা, কিন্তু অত্যন্ত রসিকা। “বদ্ধ স্বামীর” সেবা শশ্রেষা করিত, কিন্তু দিবারাত্রি উপহাস করিতেও ক্ষান্ত থাকিত না। এ প্রকার পত্নী পাইয়া বদ্ধ স্বামীর স্নেহের ও সখের সীমা ছিল না। সরলার রন্দ্রপরে আগমন অবধি অমলা তাহাকে আপন সোদরা অপেক্ষা অধিক স্নেহ করিত, প্রাণের অপেক্ষা অধিক ভালবাসিত। দুঃখের সময়ে সরলার নিম্মল বালিকা-মুখখানি দেখিয়া । সকল দুঃখ একেবারে ভুলিয়া যাইত, সখের সময়ে সরলার প্রেমপণে চক্ষ দুইটী দেখিতে পাইলে সখে দ্বিগণ হইত। ছয় বৎসরকাল একত্র থাকিয়া তাহাদের স্নেহ বদ্ধিত হইয়াছিল, ভালবাসার শেষ ছিল না। সরলা সময় পাইলেই অমলার নিকট যাইত, অমলা অবকাশ পাইলেই সরলার নিকট আসিত, কতদিন তাহারা দুইজনে মধ্যাহ্নে একত্র একটি বক্ষচ্ছায়ায় বসিয়া কোনও কায্যে নিষক্ত থাকিত, কতদিন রাত্রি দুই প্রহর পয্যন্ত দুইজনে নিভৃত স্থানে বসিয়া গল্প করিত। দুইজনের বিচ্ছিন্ন হইবার ইচ্ছা নাই, সতরাং সে গল্পেরও শেষ নাই। ফলতঃ তাহাদিগের শরীর বিভিন্ন হইলেও একই মন, একই প্রাণ, একই হৃদয় ছিল। সরলা বাটী আসিয়া দেখিল, মাতা ও ব্রহ্মচারী ঘর হইতে বাহির হইলেন। সরলা বলিল,— মা, সমস্ত রাত্রি নিদ্রা যাও নাই ? মহাশ্বেতা। না মা, ব্রহ্মচারীর সহিত কথা কহিতেছিলাম, কথায় কথায় সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। তোমার আজ ঘাট হইতে আসিতে বিলম্বব হইয়াছে—সায্য উঠিয়াছে। সরলা। হাঁ মা, আজ ঘাটে বিশ: পাগলী নামে এক সন্ত্রীলোক আসিয়াছিল। এই বলিয়া সরলা সমস্ত বক্তাস্ত বিবত করিল। তাহার মাতা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন, বিশ্বেশ্বরী পাগলিনীর জন্য অনেক অন্বেষণ করাইলেন, কিন্তু তাহাকে আর দেখা গেল না। সন্ধ্যাকাল সমাগত। মহাশ্বেতা দৈনিক রীতানুসারে স্নানাথ গমন করিলেন। কুটীরে সরলা একাকিনী কাজ করিতেছে। সমস্ত দিনের পরিশ্রমজনিত ক্লান্তিবশতঃই হউক, বা অনেকক্ষণ একাকিনী বলিয়াই হউক, সরলার মুখমণ্ডল যেন কিছয় লান বোধ হইতেছে, সন্ধ্যার ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সরলার হৃদয়ে ছায়া ঘনীভূত হইতেছে। চিত্তা কিছুই নাই, দুঃখ কিছুই নাই, তথাপি হৃদয়-আকাশ যেন অলপ অলপ মেঘাচ্ছন্ন হইতেছে। ভবিষ্যতে কোন ভয় নাই, সমতিতে কোন পরিতাপ নাই, অথচ হৃদয় আপনা হইতেই ভারগ্রস্ত। সম্মুখে চরকা ঘুরিতেছে, ললাটে ঈষৎ ঘৰ্ম্ম-বিন্দু দেখা যাইতেছে, সরলা একাকিনী বসিয়া কাৰ্য্য করিতেছে ও অতি মদস্বেরে এক এক বার গান করিতেছে। অতি মদ গন গন শব্দে একটী খেদের গান এক বার, দই বার, তিন বার সাঙ্গ হইল, এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে ডাকিল,— “সরলা!” যিনি ডাকিলেন তিনি একজন যবোপরাষ, বয়ঃক্রম বিংশতি বৎসর হইবে। মুখমণ্ডল অতি সশ্রী ও ঔদাষ ব্যঞ্জক, কিন্তু ঈষৎ গম্ভীর ও লান। কেশবিন্যাসে কিছুই যত্ন নাই, সতরাং নিবিড় কৃষ্ণকস্তল অধুনা মালিন্য প্রাপ্ত হইয়া মুখমণ্ডল কিঞ্চিৎ আচ্ছন্ন করিতেছে । চক্ষদ্বয় জ্যোতিঃপণ", কিন্তু দারিদ্র্য, অথবা দুঃখ, অথবা চিন্তায় চতুপাশ্বে কালিমা পড়িয়াছে। ললাট প্রশস্ত, বক্ষঃস্থল আয়ত, বাহযোিগল দীঘ শরীর গম্ভীর ও শাস্ত, অথচ তেজোব্যঞ্জক, আকৃতি দেখিলে সহসা বীরপরষ বলিয়া বোধ হয়। যতক্ষণ গীত হইতেছিল, আগন্তুক নিপদ-শরীরে পশ্চাতে দাঁড়াইয়াছিলেন ও অনিমেষলোচনে সরলার প্রতি নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। বোধ হয়, YO