পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী ( আসিত, এমত নহে; নানাপ্রকার লোকে নানাপ্রকার দ্রব্য বিক্রয়াথ আসিত। বালক-বালিকার জন্য নানাপ্রকার ক্রীড়াদ্রব্য, যুবক-যুবতীদের জন্য নানাপ্রকার অলঙ্কার, সকলের জন্যই পরিধেয়, খাদ্য ও অন্যান্য নানারপে ব্যবহায্য দ্রব্য তথায় দিবানিশি বিক্রয় হইত। ক্রেতৃগণ তথায় দিবানিশি ব্যস্ত রহিয়াছে। -- যখন বিমলা আপন সঙ্গিনীদিগের সহিত মহেশ্বর-মন্দিরে প’হরছিলেন, তখন রজনী আগত হইয়াছে। বিশ্রাম করিয়া আহারাদি করিতে করিতে রজনী দ্বিপ্রহর হইল। বিমলার সঙ্গিগণ তাঁহাকে সে রাত্রিতে পজা করিতে নিষেধ করিল: কিন্তু বিমলার হৃদয় চিন্তা-পরিপািণ । তিনি বলিলেন,—আমাকে ক্ষমা করন, আমি উপাসনা না করিয়া অদ্য শয়ন করিব না,—যদি করি, নিদ্রা হইবে না। এই বলিয়া বিমলা একাকিনী ধীরে ধীরে মন্দিরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। চন্দ্রোদয় হইয়াছে, সম্মুখে উচ্চ মহেশ্বর-মন্দির চন্দ্রালোকে অধিকতর উক্তজবল হইয়া গভীর নীল আকাশপটে যেন চিত্রের ন্যায় ন্যস্ত রহিয়াছে। চারিদিকে উক্তজবল শ্বেত সৌধমালা চন্দ্রকিরণে রৌপ্যমণ্ডিতের ন্যায় শোভা পাইতেছে,-সেই সৌধমালা হইতে অসংখ্য প্রদীপালোক বহিগত হইয়া নয়নপথে পতিত হইতেছে। মধ্যস্থ প্রশস্ত ভূমিখণ্ড প্রায় জনশন্যে হইয়াছে,~~ যেস্থানে সমস্ত দিন কলরব হইতেছিল, এক্ষণে সেই স্থান প্রায় নিস্তব্ধ হইয়াছে। স্থানে স্থানে । বক্ষপত্রের মধ্যে পাঞ্জ পাঞ্জ খদ্যোতমালা নয়নরঞ্জন করিতেছে। শীতল সুগন্ধ সমীরণ রহিয়া রহিয়া বহিতেছে ও নিকটস্থ উচ্চ ব্যক্ষ হইতে সমধর গম্ভীর রব বাহির করিতেছে। সেই রব ভিন্ন অন্য রব নাই; কেবল স্থানে স্থানে পেচকের শব্দ শনা যাইতেছে,-কেবল কখন কখন দরেস্থ ক্ষেত্র হইতে দুই একটা গাভীর হামবারব শনা যাইতেছে —কেবল দরেস্থগ্রামবাসীদিগের গীত গান বায়ুপথে আরোহণ করিয়া কখন কখন কণা-কুহরে প্রবেশ করিতেছে। সে সময়ে, সেস্থানে, সেই গীত শুনিতে বড় সুললিত বোধ হয়। এই নিস্তব্ধ, শান্তপথে যাইতে যাইতে বিমলার হৃদয়ও কিছু শান্ত হইল ; চিন্তা কিঞ্চিৎ পরিমাণ দরে হইতে লাগিল ; প্রকৃতির নিস্তব্ধতা দেখিয়া বিমলার হৃদয়েও শান্তভাবের আবিভাব হইতে লাগিল। সেই দেবায়তনে প্রাতঃকালে দলই একটী করিয়া লোক সমবেত হয়; মধ্যাহ্নে কোলাহলের সীমা থাকে না ; সায়ংকালে সেই কলরব ক্রমে হ্রাস হইয়া আইসে ; রজনীতে সমস্ত নিজন, নিস্তব্ধ, শান্ত! বিমলা বিবেচনা করিতে লাগিলেন,—আমাদের জীবনেও এইরুপ । –যেন জগৎসংসারকে গ্রাস করিবে; বাদ্ধক্যে ক্রমে নিস্তেজ হইয়া আইসে : শীঘ্রই শান্ত, নিস্তব্ধ, অনন্ত সাগরে লীন হইয়া যায়—বারিবিন্দর মত অনন্ত সাগরে লীন হইয়া যায়। তবে এত ধুমধাম কেন ?—এত দপ, এত গন্ধ", এত কৌশল, এত মন্ত্রণা কেন ? এত ক্রোধ, এত লোভ, এত অথ’লালসা, এত উচ্চাভিলাষ কেন ?—কে বলিবে কেন ? বিধির নিবন্ধ কে বুঝিবে ? যে পতঙ্গ মহত্তেমধ্যে ভস্মসাৎ হইবে, তাহার পক্ষবিস্তার করিয়া আকাশদিকে ধাবমান হওয়া কেন ? যে শিশিরবিন্দ মহত্তমধ্যে মনুষ্যপদে দলিত হইবে বা প্রাতঃকালের রবিকিরণসপশে শুকাইয়া যাইবে, তাহার হীরকখন্ডের জ্যোতিঃ বিস্তার কেন ? 品 এই প্রকার চিন্তা করিতে করিতে বিমলা সহসা রজনী দ্বিপ্রহরের ঘন্টারব শুনিতে পাইলেন, সেই ঘণ্টারব চতুদিকস্থ সৌধমালায় প্রতিহত হইয়া দশগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া বায়মাগে সঞ্চরণ করিতে লাগিল, নিস্তব্ধ নৈশগগনে আরোহণ করিয়া সঞ্চরণ করিতে লাগিল। ঘণ্টারব শেষ না হইতে হইতে দ্বিপ্রহরের প্রজা আরম্ভ হইল। সপ্তস্বরে মিলিত হইয়া মহেশ্বরের অনন্ত মহিমা গীত হইতে লাগিল; কাদম্বিনীর গম্ভীর নিঘোষবৎ সেই গীত কখন মন্দীভূত, কখন সতেজে উচ্চারিত হইতে লাগিল; উপাসকদিগের মন দ্রবীভূত হইতে লাগিল। বিমলা সপ্তস্বরে সেই গানের সহিত যোগ দিলেন : তাঁহার হৃদয় পবিত্র প্রেমে ও উল্লাসে প্লাবিত হইতে লাগিল । বিমলা যখন মন্দিরের ভিতর আসিয়া পাহছিলেন, তখন আর অধিক উপাসক ছিল না, প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছিল। বিমলা পজায় রত হইলেন। প্রায় এক প্রহর কাল মাদিতনয়নে, নিপন্দশরীরে, বিমলা পজা করিতে লাগিলেন। হৃদয়ে যে পবিত্র কামনা উদয় হইতেছিল, বিমলার বদনমণ্ডলে তদনরপে পবিত্র ভাব অঙ্কিত হইতে লাগিল। বিমলার মাতা, ভ্রাতা, ভগিনী, স্বামী, বন্ধ কেহ নাই, পিতাই একমাত্র ভক্তির আধার, 会心