পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রমেশ রচনাবলী রহিয়াছে, আর দুই একখানি ক্ষুদ্র তরী ভাসিতেছে। শীতল সমীরণ ক্ষেত্রস্থিত শিশির বিন্দতে সিক্ত হইয়া অধিকতর শীতল হইয়া বহিতেছে, আর ঘাটে যে সকল রমণী স্নান করিতে বা জল লইতে আসিয়াছে, তাহাদিগের শরীর পুলকিত করিতেছে। কৃষকগণ গরম লইয়া মাঠে । যাইতেছে ও রহিয়া রহিয়া আনন্দে গান করিতেছে, এবং পক্ষিগণ তরণে অরণে কিরণে পলকিত হইয়া সেই গানে যোগ দিতেছে। সমস্ত জগৎ আলোকময় ও আনন্দময়। সেই প্রকাণ্ড দগের নিম্নতলে একটী নিভৃত ঘরে একটী হীনজ্যোতি প্রদীপালোকে মহাশ্বেতা ও সরলা শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহারা শকুনির চর দ্বারা আনীত হইয়া এই দগে বন্দী হইয়াছেন। সরলা নিদ্রিত। মাতৃক্রোড়ে শিশরে ন্যায় মহাশ্বেতার পাশ্বে বালিকা নিদ্রিত রহিয়াছে, সমস্ত রাত্রি জাগরণের পর সরলা নিদ্রা যাইতেছে। সরলার শরীর ক্ষীণ হইয়াছে, চক্ষ দুইটী কোটরে প্রবিল্ট হইয়াছে, মুখমণ্ডলে পড়বের ন্যায় প্রফুল্লতা বা বালিকাভাব দেখা যায় না, সরলা আর বালিকা নাই। সহসা অসীম শোকসাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়া বালিকা-সলভ সখস্বপ্ন জাগরিত হইয়াছে। সরলার পাশ্বে মহাশ্বেতা অনিদ্র হইয়া শয়ন করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার মুখে যে ভাব । লক্ষিত হইতেছে তাহা বর্ণনাতীত, সে ভাব ভয়ের নহে, দুঃখের নহে, কেবল চিন্তার নহে নয়ন জনলিতেছিল, সক্ষম ওঠের উপর দন্ত চাপিয়া রহিয়াছে, সমস্ত মুখমণ্ডলে উন্মত্ততার চিহ্ন লক্ষিত হইতেছে। ললাটের শিরা সফীত হইয়া উঠিয়াছে, হৃদয় পর্বোসমতি ও চিন্তাতরঙ্গে প্লাবিত হইতেছে। ক্ষণেক পর সরলা জাগিল। উঠিয়া মাতার মুখমণ্ডলে চাহিয়া বলিল,—মা, সমস্ত রাত্রি তোমার নিদ্রা হয় নাই ? মহাশ্বেতা কোনও উত্তর করিলেন না। সরলা আবার বলিল,— মা, তোমার জন্য কল্য যে অন্ন রাখিয়া গিয়াছে তাহা এখনও সপশ কর নাই, যেরপে ছিল সেইরাপ আছে ? মহাশ্বেতা উত্তর করিলেন,—না মা, আহারে রচি নাই। সরলা । না খাইলে শরীর কতদিন থাকিবে ? মহাশ্বেতা। বাছা, আর শরীর থাকার আবশ্যক কি ? ভগবান অনুগ্রহ করিয়া যদি ইহার অগ্ৰেই আমার মৃত্যু ঘটাইতেন, তাহা হইলে তোমাকে এ অবস্থায় দেখিতে হইত না। সরলা। মা, তুমি না থাকিলে আমি কাহার মুখ চাহিয়া থাকিব, জগতে আর আমার কে আছে যে তুমি আমাকে ছাড়িয়া যাইবে ? মহাশ্বেতা সজলনয়নে উত্তর করিলেন,—না মা, হতভাগিনীর এখনও যাইবার সময় হয় নাই। • এইরুপ কথাবাত্ত হইতেছে এমন সময়ে ঘরের দ্বার খলিল। মহাশ্বেতা দ্বারের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, একজন নিরুপমা সন্দেরী দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন। বলিবার আবশ্যক নাই যে, সে সন্দেরী বিমলা। বিমলা যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার হৃদয় একেবারে দুঃখে অধীর হইল। দেখিলেন পবেদিনের খাদ্যদ্রব্য এখনও স্পশ করা হয় নাই, বদ্ধা মহাশ্বেতা প্রায় উন্মত্তের ন্যায় হইয়াছেন, তাহার পাশ্বে বালিকা বসিয়া নীরবে রোদন করিতেছে। বিমলা আপন চক্ষ মাছিয়া, মহাশ্বেতাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন–মাতঃ! আপনাদিগের কট দেখিয়া আমার হৃদয় বিদীণ হইতেছে, আপনারা বাহিরে আইসন। রমণীকণ্ঠনিঃসন্ত কর্ণাসচক কথা শুনিয়া মহাশ্বেতা সেইদিকে চাহিলেন, জিজ্ঞাসা কে? বিমলা উত্তর করিলেন,—এই দলগাধিপতি সতীশচন্দ্রের দুহিতা, আমার নাম | ক্রোধে মহাশ্বেতা শিহরিয়া উঠিলেন। ক্ষণেক পর ধীরে ধীরে বলিলেন,--তোমার পিতাকে বলিও, আমাদের আর অধিকদিন বাঁচিবার নাই, যে কয়েকদিন আছি, আমাদিগকে নিজনে, থাকিতে দাও, তোমরা আসিয়া বিরক্ত করিও না। অন্য সময়ে এরপে উত্তর পাইলে মানিনী বিমলা ক্রুদ্ধ হইতেন, কিন্তু বন্দীদিগের অবস্থা দেখিয়া তাঁহার হৃদয়ে ক্রোধের লেশমাত্র উদয় হইল না। তিনি ধীরে ধীরে উত্তর করিলেন, G之