ঘরে ও বাহিরে গভীর শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। মাতঙ্গিনীর কক্ষে প্রদীপ ছিল না, গাঢ় অন্ধকারে কক্ষ আচ্ছন্ন ছিল, কেবল ক্ষুদ্র গবাক্ষের ফাটল দিয়া খানিকটা প্রদীপ্ত চন্দ্রকিরণ ঠাণ্ডা মাটির মেঝের উপরে আলোর একটি রেখা টানিয়া দিয়াছিল! উপাধান হইতে ঈষৎ ঊর্দ্ধে আপনার বাহুর উপর মাথা রাখিয়া, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের প্রকোপে বক্ষদেশ হইতে অঞ্চলথানি কোমর অবধি টানিয়া সেই চন্দ্রকিরণরেখার পানে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে মাতঙ্গিনীর স্মৃতিপথে তাহার শৈশবের কথা উদিত হইল—যখন সে ভাবনা-বিরহিত লঘু শিশু-চিত্ত লইয়া সায়াহ্নসূর্য্যকরে নাচিয়া খেলিয়া বেড়াইত। হায় রে শৈশব! স্নেহের হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে হাত ধরাধরি করিয়া খোলা আকাশের তলে শুইয়া স্নিগ্ধরশ্মি-বিকিরণকারী সীমাহীন নীল আকাশ-সমুদ্রে সন্তরমান রৌপ্যগোলকের দিকে চাহিয়া কাটানো শৈশব! শিশুমনের প্রিয় কত কাহিনীই যে তাহারা পরস্পরকে শুনাইত, অথবা স্নেহময়ী ঠাকুরমার মুখে শুনিত—কি সে একাগ্রতা আর আনন্দ! এই আট বৎসরে কত পরিবর্ত্তনই যে ঘটিয়াছে! সেই উচ্চ কলকণ্ঠ কোথায় মিলাইয়াছে, যে মুখগুলিকে সে ভালবাসিত, যাহাদের স্মৃতি তাহার অন্তরে সযত্নে রক্ষিত ছিল, সেগুলি পর্য্যন্ত যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে! সেই স্মিত হাসি, সেই স্নেহবিজড়িত কণ্ঠস্বর—হায় রে, সেই হাসি দেখিবার জন্য ও সেই স্নেহমস্বর শুনিবার জন্য আজ সে তাহার সর্বস্ব দিতে পারে। তাহার অন্তরের প্রেম-প্রস্রবণ নিত্য উৎসারিত হইতে চায়, কিন্তু পাষাণের অন্তরায়। উৎস-মুখেই সেই স্বর্গ-মন্দাকিনী-ধারা কাহার রূঢ় নিশ্বাসে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। বেদনাময় একটি স্মৃতি—বেদনাময় তবু এত মধুর যে বারম্বার সেই কথাই ঘুরিয়া ফিরিয়া মনে জাগে—তাহার অতীত সৌভাগ্যের সহিত বর্ত্তমান দুর্ভাগ্যের সংযোগ রক্ষা করিতেছিল। সেই স্মৃতি সে ভুলিতে চায়, কিন্তু পারে কই? ভাবিতে ভাবিতে কনকের কথা তাহার মনে পড়িল; তাহার কাছাকাছি সেই এখন একমাত্র প্রাণী,
পাতা:রাজমোহনের স্ত্রী.djvu/৩৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
রাজমোহনের স্ত্রী
২৯