পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২২
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ।

ইংরাজগণ তাঁহাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করিলেন। যশোর, নদীয়া প্রভৃতি জেলার জমিদারগণের ও প্রজাগণের সহিত নীলকরদিগের ঘোর বিবাদ বাঁধিয়া গেল। অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। জেলার মাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি নীলকরদিগের স্বজাতীয়, সুতরাং প্রজারা প্রায়ই সুবিচার লাভ করিত না। কিন্তু তাহারা ইহাতেও দমিত না; অনেকে ধনে প্রাণে সারা হইয়া যাইত, তবু নিরস্ত হইত না। এই সময়ে হরিশচন্দ্র অত্যাচরিত প্রজাবৃন্দের পক্ষ হইয়া লেখনী ধারণ করিলেন। অবশেষে প্রধানতঃ তাঁহারই চেষ্টাতে গবর্ণমেণ্ট এই ১৮৬০ সালেই “ইণ্ডিগো কমিশন” নামে এক কমিশন নিযুক্ত করিলেন। তাহার সভ্যগণ জেলার জেলায় ঘুরিয়া নীলের অত্যাচার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। হরিশ কমিশনের সমক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। চারিদিক হইতে নীলকরদিগের উপরে ছি ছি রব উঠিল। নীলকরগণ জাতক্রোধ হইয়া আর্কিবল্‌ড হিল্‌স নামক একজন নীলকরকে খাড়া করিয়া পেট্রিয়টের নামে আদালতে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে ফৌজদারি মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইল। ভবানীপুর সুপ্রিম কোর্টের এলাকাভূক্ত নয় বলিয়া সে মোকদ্দমা উঠিয়া গেল। কিন্তু এই সকল গোলমালে হরিশের ভগ্ন শরীরে আর সহিল না। ১৮৬১ সালের জুন মাস ৩৭ বৎসর বয়সে তিনি এলোক হইতে অন্তর্হিত হইলেন।

 মানুষের দেহে আর কত সয়! সে সময়ে যাহারা হরিশের দুরন্ত পরিশ্রম দেখিয়াছেন, তাহারা বলেন যে রাত্রির কয়েক ঘণ্টা কাল ব্যতীত হরিশের আর বিশ্রাম ছিল না। একে “পেট্রিয়ট” পত্রিকার সম্পাদকতা কাজ, সেজন্য তাঁহাকে রাশি রাশি সংবাদপত্র পড়িতে হইত, ও প্রবন্ধাদি লিখিতে হইত, তদুপরি দিবারাত্রি নীলকর প্রপীড়িত প্রজাবৃন্দের সমাগম। তাহার ভবন সর্ব্বদা লোকারণ্য থাকিত। কাহারও দরখাস্ত লিখিয়া দিতে হইতেছে, কাহাকেও উকিলের নিকট সুপারিস চিঠী দিতে হইতেছে, কাহারও মোকদ্দমার হাল শুনিতে হইতেছে; বিশ্রাম নাই। অনেক দিন আফিস হইতে ফিরিয়া মাত্রি দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত আর আফিসের পোষাক বদলাইবার সময় পাইতেন না। আফিসের কলম ছাড়িয়া আসিয়া আবার কলম ধরিয়া বসিয়া যাইতেন। তাঁহার জননী এই গুরুতর শ্রমের প্রতিবাদ করিয়া টিক্ টিক্‌ করিতেন। বলিতেন “ওরে মানুষের শরীরে এত শ্রম সবে না, ওরে মারা পড়বি, ওরে কলম