পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/২৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নবম পরিচ্ছেদ।
২৩৭

সাহিত্য সিংহাসনে তাহার আসন চিরদিনের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। তাহার জীবনচরিতকার সত্যকথাই বলিয়াছেন, এবং আমাদেরও ইহা অত্যাশ্চর্য্য বলিয়া মনে হয় যে তাঁহার লেখনী যখন “মেঘনাদের” বীররস চিত্রনে নিযুক্ত ছিল, তখন সেই লেখনীই অপরদিকে “ব্রজাঙ্গনার” সুললিত মধুর রস চিত্রনে ব্যাপৃত ছিল। এই ঘটনা তাঁহার প্রতিভাকে কি অপুর্ব্ববেশে আমাদের নিকট আনিতেছে! একই চিত্রকর একই সময়ে কিরূপে এরূপ দুইটী চিত্র চিত্রিত করিতে পারে! দেখিয়া মনে হয়, মধুসূদনের নিজ প্রকৃতিকে দ্বিভাগ করিবার শক্তিও অসাধারণ ছিল। তাঁহার জন্যই বোধ হয় এত দুঃখ দরিদ্র্যের মধ্যে, এত ঘনঘোর বিধাদের মধ্যে, এত জীবনব্যাপী অতৃপ্তি ও অশাস্তির মধ্যে বসিয়া তিনি কবিতা রচনা করিতে পারিয়াছেন!

 যাহা হউক তিনি কলিকাতাতে আসিয়া একদিকে যেমন কাব্য-জগতে নবযুগ আনয়নের চেষ্টা করিতে লাগিলেন, অপরদিকে জ্ঞাতিগণের হস্ত হইতে নিজ প্রাপ্য পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সে বিষয়ে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছিলেন, তাহা বলিতে পারি না। তবে এ কথা নিশ্চিত, যে তিনি যাহা কিছু পাইয়াছিলেন ও যাহা কিছু নিজে উপার্জ্জন করিতেন, হিসাব করিয়া চলিতে পারিলে তাহাতেই এক প্রকার দিন চলিবার কথা ছিল। কিন্তু পিতামাতার যে আদুরে ছেলে জীবনে একদিনের জন্য আয় ব্যয়ের সমতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে নাই, সে আজ তাহা করিবে কিরূপে? কিছুতেই মধুর দুঃখ ঘুচিত না। প্রবৃত্তিকে যে কিরূপে শাসনে রাখিতে হয় তাহা তিনি জানিতেন না। মনে করিতেন প্রবৃত্তির চরিতার্থতাই মুখ। রাবণ তাহার আদর্শ, “ভিখারী রাঘব” নহে; সুতরাং হস্তে অর্থ আসিলেই তাহা প্রবৃত্তির অনলে আহুতির ন্যায় যাইত! সুধের জোয়ার দুইদিনের মধ্যে ফুরাইয়া, মধু ভাটার কাটখানার মত, যে চড়ার উপরে, সেই চড়ার উপরে পড়িয়া থাকিতেন। কেহ কি মনে করিতেছেন ঘৃণার ভাবে এই সকল কথা বলিতেছি? তা নয়। এই সরস্বতীর বরপুত্রের দুঃখ দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করিয়া চক্ষের জল রাখিতে পারি না; অথচ এই কাব্যকাননের কলকণ্ঠ কোকিলকে ভাল না বাসিয়াও থাকিতে পারি না। অন্ততঃ তাঁহাতে একটা ছিল না; প্রদর্শনের ইচ্ছ ছিল না। কপটতা বা ভণ্ডামির বিন্দুমাত্র ছিল না। এই জন্য মধুকে ভালবাসি। আর একটা কথা, এমন প্রাণের তাজা ভালবাসা মানুষকে অতি অল্পলোকেই দেয়, এজন্যও মধুকে ভালবাসি।