পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/৩০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫২
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ।

ভেরীনিনাদ ছিল, তাহাও অগ্রে নির্দেশ করিয়াছি। কিন্তু ঐ “আলালী’ ভাষা গ্রাম্যতা দোষে কিছু অতিরিক্ত মাত্রায় দূষিত ছিল। যথা “টক্ টক্‌ পটাস পটাস মিয়াজান গাড়োয়ান এক এক বার গান করিতেছে—টিট্‌কারি দিতেছে, হাঃ শালার গরু বলিয়া লেজ' মুছড়াইয়া সপাৎ সপাৎ মারিতেছে।” ইত্যাদি ভাষা যে গ্রন্থে বা পত্রিকাতে মুদ্রিত হইলে গ্রাম্যতা দোষ ঘটে তাহা সকলেই অনুভব করিতে পারেন। সুতরাং এই আলালী ভাষা বঙ্গীয় পাঠক বৃন্দের সম্পূর্ণ ভাল লাগিত না।

 ইহার পরে হুতোমের নক্সা প্রকাশিত হয়। তাহাও প্রায় এই আলালী ভাষাতে লিখিত। কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোমের নক্সা লিখিয়া অমর হইয়াছেন। তাঁহার জীবন্ত হৃদয়গ্রাহী বাঙ্গালা আমাদিগকে বড়ই প্রীত করিয়াছিল। কিন্তু তাহাও গ্রাম্যতা দোষের উপরে উঠিতে পারে নাই।

 সন্ধিস্থলে বঙ্কিমচন্দ্র আবির্ভূত হইলেন। তিনি যৌবনের প্রারম্ভে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া পদ্যরচনাতে সিদ্ধহস্ততা লাভ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন; কিন্তু মধুসূদনের দীপ্ত প্রভাতে আপনাকে পরীক্ষা করিয়া জানিতে পারিলেন যে সে পথ তাহাকে পরিত্যাগ করিতে হইবে। কিন্তু তিনি শুভক্ষণে গদ্যরচনাতে লেখনী নিয়োগ করিলেন। অচিরকালের মধ্যে বঙ্গের সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল তারকার ন্যায় বঙ্কিম দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। বঙ্গবাসীয় চিন্তা ও চিত্তের উন্মেষ পক্ষে যত লোক সহায়তা করিয়াছেন তন্মধ্যে ইনি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি।

 এই কালের মধ্যে নাটক ও উপন্যাস রচনা দ্বারা বঙ্গসমাজে যে পরিবর্তন ঘটাইয়াছিল তাহা কথঞ্চিৎ প্রদর্শন করিয়া আর এক সুমহৎ বিপ্লবের বিষয় উল্লেখ করিতে যাইতেছি। তাহা বঙ্গীয় সাহিত্যজগতে “সোমপ্রকাশের” অভ্যূদয়। ইংরাজ রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর হইতেই কিরূপে সংবাদপত্রের আবির্ভাব হইয়া, তাহা কত প্রকার অবস্থার মধ্য দিয়া চলিয়া আসিয়াছে তাহার বিবরণ অগ্রেই দিয়াছি। সংবাদপত্র প্রথমে ইংরাজদিগের দ্বারা সম্পাদিত হইতে আরম্ভ হয়। তৎপরে শ্রীরামপুরের মিশনারিগণ তাঁহাদের দর্পণ নামক পত্রের সৃষ্টি করিয়া বাঙ্গালা সংবাদ পত্রের পথ খুঁলিয়া দেন। কিন্তু “দর্পণ” ইংরাজদিগের দ্বারাই সম্পাদিত হইত এবং তাহার ভাষা ইংরাজ-লিখিত বাঙ্গালা হইত। প্রকৃত পক্ষে রাজা রামমোহন রায় এ দেশীয় দ্বারা লিখিত বাঙ্গালা সংবাদপত্রের পথ প্রদর্শক। তিনিই ১৮২১ সালে “সংবাদ কৌমুদী” নামে সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ