হইতে দূরে আসিয়া পুরুষদলের নীচ আমোদের মধ্যে পড়িয়া থাকিত, তাহাদের পক্ষে এই স্নেহ ও ভালবাসা যে কি মহা ইষ্টসাধন করিত তাহা এখন বাক্যে বর্ণনা করিতে পারি না। উত্তরকালে যাঁহারা বঙ্গদেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, তাহাদের অনেকে নারীগণের এইরূপ অযাচিত স্নেহ পাইয়া মানুষকে ভালবাসিতে শিখিয়াছিলেন। পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাল্যবন্ধু গোপালচন্দ্র ঘোষের জননী রাইমণির কথা সকলেই অবগত আছেন। রাইমণি প্রবাস-সমাগত ঈশ্বরচন্দ্রের মাসীর স্থান অধিকার করিয়া, তাহার অতুলনীয় স্নেহ ও যত্নের দ্বারা কিরূপে তাঁহার হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত জীবনচরিত হইতে তাহ উদ্ধৃত করিতেছি—
“তাহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ন থাকা উচিত ও আবশ্যক, গোপালচন্দ্রের উপর রাইমণির স্নেহ ও যত্ন তদপেক্ষা অধিকতর ছিল তাহাতে সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ় বিশ্বাস এই, স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে আমায় ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্নতা ছিল না। ফল কথা এই, স্নেহ, দয়া, সৌজন্য, অমায়িকতা, সদ্বিবেচনা, প্রভৃতি সদ্গুণ বিষয়ে রাইমণির সমকক্ষ স্ত্রীলোক এ পর্য্যন্ত আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই দয়াশীল সৌম্যমূর্ত্তি আমার হৃদয়মন্দিরে দেবীমূর্ত্তির ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া বিরাজমান রহিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার কথা উপস্থিত হইলে তদীয় অপ্রতিম গুণের কীর্ত্তন করিতে করিতে অশ্রুপাত না করিয়া থাকিতে পারি না। আমি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী বলিয়া অনেকে নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। আমার বোধ হয় সে নির্দ্দেশ অসঙ্গত নহে। যে ব্যক্তি রাইমণির সেই দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করিয়াছে, এবং ঐ সমস্ত গুণের ফলভোগী হইয়াছে, সে যদি স্ত্রীজাতির পক্ষপাতী না হয় তাহা হইলে তাহার তুল্য কৃতঘ্ন পামর ভূমণ্ডলে নাই।”
ঠিক কথা! বিদ্যাসাগর যে কলিকাতার ন্যায় প্রলোভনপূর্ণ স্থানে পদার্পণ করিয়া সুরক্ষিত হইয়াছিলেন, তাহা অনেকটা রাইমণির স্নেহের গুণে। রামতনু বাবুও যে সুকুমার বয়সে, পাপপ্রলোভনের মধ্যে বাঁচিয়াছিলেন, তাহাও যে অনেকটা রামকান্ত খাঁ মহাশয়ের গৃহিণীর ও দিগম্বর মিত্রের মাতার স্নেহের গুণে তাহাতে কি সন্দেহ আছে? মাতা ও ভগিনীর স্নেহ ছাড়িয়া যিনি আসিয়াছিলেন, তাহার পক্ষে এই স্নেহ এক মহা রক্ষাকবচের ন্যায় হইয়াছিল।