দুষ্ট ছিল এবং ইহাতে অসঙ্গত অনুপ্রাস ও উপমার এত ছড়াছড়ি থাকিত যে এখন আমাদের আশ্চর্য্য বোধ হয় কিরূপে লোকে তাহাতে প্রীত হইত। কিন্তু তখন লোকে পাঁচালী গান শুনিবার জন্য পাগল হইত।
বুলবুলির লড়াই দেখা ও ঘুড়ী উড়ান সে সময়ে সহরের ভদ্রলোকদিগের একটা মহা আনন্দের বিষয় ছিল। এক একটা স্থানে লোহার জাল দিয়া ঘিরিয়া বহু সংখ্যক বুলবুলী পক্ষী রাখা হইত; এবং মধ্যে মধ্যে ইহাদের মধ্যে লড়াই বাঁধাইয়া দিয়া কৌতুক দেখা হইত। সেই কৌতুক দেখিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িত। ঢাউসঘুড়ী, মানুষঘুড়ী, প্রভৃতি ঘুড়ীর প্রকার ও প্রণালী বহুবিধ ছিল; এবং সহরের ভদ্রপৃহের নিষ্কর্ম্মা ব্যক্তিগণ গড়ের মাঠে গিয়া ঘুড়ীর খেলা দেখিতেন।
সহুরের লোকের ধর্ম্মভাবের অবস্থা তখন কি প্রকার ছিল তাহার কিঞ্চিৎ বিবরণ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রণীত মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিতে উদ্ধৃত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র উক্তি হইতে তুলিয়া দেওর যাইতেছে।
“বেদের যে সকল কর্ম্মকাণ্ড, উপনিষদের যে ব্রহ্মজ্ঞান, তাহার আদর এখানে কিছুই ছিল না। কিন্তু দুর্গোৎসবের বলিদান, নন্দোৎসবের কীর্ত্তন, দোলযাত্রীর আবীর, রথযাত্রার গোল, এই সকল লইয়াই লোকের মহা আমোদ ছিল। লোকে মনের আনন্দে কালহরণ করিত। গঙ্গাস্নান, ব্রাহ্মণ বৈঞ্চবে দান, তীর্থভ্রমণ, অনশনাদি দ্বারা তীব্রপাপ হইতে পরিত্রাণ পাওরা যায়, পবিত্রতা লাভ করা যায়, পুণ্য অর্জন করা যায়, ইহা সকলের মনে একেবারে স্থির বিশ্বাস ছিল; ইহায় বিপক্ষে কেহ একটিও কথা বলিতে পারিতেন না। অল্পের বিচারই ধর্ম্মের কাষ্ঠাভাব ছিল; অন্নশুদ্ধির উপরেই বিশেষরূপে চিত্তশুদ্ধি নির্ভর করিত। স্বপাক হবিষ্য ভোজন অপেক্ষা আর অধিক পবিত্রকর কর্ম্ম কিছুই ছিল না। কলিকাতার বিষয়ী ব্রাহ্মণেরা ইংরাজদিগের অধীনে বিষয় কর্ম্ম করিয়াও স্বদেশীয়দিগের নিকটে ব্রাহ্মণজাতির গৌরব ও আধিপত্য রক্ষা করিবার জন্য বিশেষ যত্ন করিতেন। তাঁহারা কার্য্যালয় হইতে অপরাহ্নে ফিরিয়া আসিয়া অবগাহন স্নান করিয়া ম্লেচ্ছসংস্পর্শজনিত দোষ হইতে মুক্ত হইতেন এবং সন্ধ্যা-পূজাদি শেষ করিয়া দিবসের অষ্টম ভাগে আহার করিতেন। ইহাতে তাঁহারা সর্ব্বত্র পূজ্য হইতেন এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁহদের যশ সর্ব্বত্র ঘোষণা করিতেন। যাঁহার এত কষ্ট স্বীকার করিতে না পারিতেন