পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২
রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র

উচ্চারণের অধিকারে বঞ্চিত হইতে হইয়াছিল। অতি প্রাচীন কালে দেখিতে পাই, নারীগণেও বেদমন্ত্র প্রচার করিতেছেন, নারীগণের মধ্যেও ঋষি আছেন, ব্রহ্মবাদিনী আছেন। এমন কি, আচার্যগৃহে উপনীত হইয়া বেদের কর্মকাণ্ড এবং জ্ঞানকাণ্ড আলোচনা করিতেছেন, এরূপ দৃষ্টান্তেরও অভাব নাই। কিন্তু এ-কালে যেমন licensed residenceএ বাস না করিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অধিকার জন্মে না, সেইরূপ বিনা উপনয়নে অর্থাৎ বিনা আচার্যগৃহবাসে বেদবিদ্যা লাভের সুযোগ না ঘটায় স্ত্রীলোকেরা ক্রমশঃ বেদাভ্যাসে সুযোগ ও বেদের উচ্চারণে অধিকার হারাইয়াছিলেন। বেদমন্ত্রের উচ্চারণ নিতান্ত সহজ কথা নহে। যথাযথ উচ্চারণ শিক্ষার জন্য ‘শিক্ষা’ নামে একটা বেদাঙ্গ বিদ্যারই উদ্ভব হইয়াছিল। বিশেষতঃ বেদের ভাষা যখন অপ্রচলিত হইয়া পড়িল, তখন আচার্যের বিনা উপদেশ বেদমন্ত্র যথাযথ উচ্চারণ হইতে পারিত না। আবার যথোচিত উচ্চারিত না হইলে বেদমন্ত্রের ফল পাওয়া যায় না। এমন কি, উলটা ফল হইবারও আশঙ্কা থাকে। ‘ইন্দ্রশত্রু’ শব্দের উচ্চারণ-দোষে কিরূপ ফলবিপর্যয় ঘটিয়াছিল, সে গল্প আপনারা শুনিয়া থাকিবেন। যজমানের পত্নী বেদমন্ত্র উচ্চারণ করিতে না পারিলেও বৈদিক ক্রিয়াকর্মে তাঁহার পূরা অধিকার ছিল। কেন না, পত্নী উপস্থিত না থাকিলে যজ্ঞই চলিত না; পত্নীকেও কয়েকটি অনুষ্ঠান করিতে হইত; এবং যজমান-পত্নীও যজ্ঞফলের সমান ভাগ পাইতেন।
যজ্ঞের মধ্যে কতকগুলি নিত্য—কতকগুলি কাম্য। কাম্য কর্ম স্বেচ্ছাধীন। যিনি বিশেষ কোনও ফল আকাঙ্ক্ষা করেন, তিনি তদনুযায়ী কাম্য কর্ম করিবেন; না করিলে কোন হানি নাই। কিন্তু নিত্যকর্ম অবশ্যকর্তব্য; না করিলে প্রত্যবায় ঘটে। কিন্তু সেই নিত্যকর্ম সম্পাদনের জন্য কোনরূপ রাজদণ্ডের ব্যবস্থা ছিল না। সমাজে হয়ত নিন্দা হইত; সমাজে পাতিত্য হইত কি না, তাহা বলিতে পারি না। এদেশের সমাজবিধি কাহাকেও জোর করিয়া কোন কাজ করাইতে চাহে না। নিত্যকর্ম না করিলে যে পাপ, কর্মকর্তা তার ফল ভোগ করিবে। অন্যের তাহাতে যায় আসে কি?
উপনয়নের পর ব্রহ্মচারী আচার্যের বাড়ীতে বাস করিতেন। আচার্যের বাড়ীতে অগ্নি থাকিত। উহা আচার্যের নিজস্ব অগ্নি। ব্রহ্মচারী প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় আচার্যের সেই অগ্নিতে একখানি কাঠ ফেলিয়া দিতেন। ইহাই তাহার সমিৎহোম। যজ্ঞিয় কাঠের টুকরোটির নাম সমিৎ। আচার্যগৃহে বেদাধ্যয়ন শেষ হইলে সমাবর্তনের পূর্বে অথবা সমাবর্তনের পরে অগ্নি স্থাপন করিতে হইত; পত্নী-গ্রহণকালে এই অগ্নিতেই লাজহোমাদি সম্পন্ন করিতে হইত। এই অগ্নির নাম গৃহ্য অগ্নি, আবসথ্য অগ্নি বা স্মার্ত অগ্নি। গৃহস্থাশ্রমের সমুদয় স্মার্ত কর্ম অর্থাৎ পাকযজ্ঞাদি অনুষ্ঠান এই গৃহ্য অগ্নিতেই সম্পাদিত হইত।
এই পাকযজ্ঞ শব্দটির মানে বুঝা দরকার। এখনও গৃহস্থের ঘরে যাগ যজ্ঞ কিছু-না-কিছু অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। শ্যামাপূজা প্রভৃতি তান্ত্রিক পূজার হোমের অনুষ্ঠান হয়। এই হোম তান্ত্রিক হোম; ইহা বৈদিক যজ্ঞ নহে। হয়ত ইহা বৈদিক যজ্ঞের