পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা : রাষ্ট্র ও নেশন ԾՑԳ ভারতবর্ষের সহিত ইউরোপের কোন একটা দেশের তুলনা ঠিক সঙ্গত নহে। বরং সমগ্র ইউরোপের সহিত ভারতবর্ষের তুলনা হইতে পারে। আয়তনে ও লোকংখ্যায় ভারতবর্ষের সহিত ইউরোপ মহাদেশেরই তুলনা হয় ; ইউরোপের অন্তর্গত কোন দেশেরই তুলনা হয় না। রোম সম্রাট সমগ্র ইউরোপকে একচ্ছত্র করিতে পারেন নাই। দুই সহস্ৰ বৎসর চেষ্টার পর সেই চেষ্টা নিষ্ফল বলিয়া পরিত্যক্ত হইয়াছে। সমগ্র ইউরোপ খৃষ্টান ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছে ; কিন্তু এক হয় নাই। প্রায় সমগ্র ইউরোপ রোমের সভ্যতার উত্তরাধিকারী, তথাপি সমগ্র ইউরোপ এক হয় নাই। তখন ভারতবর্ষের মত প্রকাণ্ড দেশ, যাহা আয়তনে ইউরোপ অপেক্ষা অধিক ছোট নহে, যাহার লোকসংখ্যা ইউরোপের সমান, যাহার ভিতরে বর্ণভেদ, জাতিভেদ, ধৰ্ম্মভেদ, ভাষাভেদ, আচারভেদ প্রভৃতি ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশী, সেই প্রকাগু দেশের সমগ্র অধিবাসী যে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বষ্টি করে নাই, ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই। বরং ইউরোপের মধ্যে যেরূপ জাতিবিদ্বেষ ও ধৰ্ম্মবিদ্বেষ বর্তমান, ভারতবর্ষের মধ্যে সেইরূপ জাতিবিদ্বেষ ব| ধৰ্ম্মবিদ্বেষ কোনও কালে ছিল না। ইংরাজ ও ফরাসী, ফরাসী ও জাৰ্ম্মান, জাৰ্ম্মান ও রুশ, ইংরাজ ও রুশ, ইহাদের মধ্যে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতী, ঈৰ্ষা, বিদ্বেষের মাত্রা অত্যন্ত তীব্র । বাঙ্গালী ও বেছর, বেহারী ও পাঞ্জাবী, মারাঠা ও রাজপুত, ইহাদের মধ্যে সেরূপ তীব্র বিদ্বেষ বা ঈর্ষ। কোনও কালেই ছিল না। আবার ইউরোপে প্রোটেষ্টাণ্ট ও কাথলিকের মধ্যে যেইরূপ বিদ্বেষ, মারামারি, রক্তারক্তি ঘটিয়াছে, ভারতবর্ষের হিন্দুসমাজের বিভিন্ন ধৰ্ম্মসম্প্রদায়মধ্যে, শাকে শৈবে বা শাক্তে বৈষ্ণবে, এমন কি, হিন্দু বেীদ্ধেও সেরূপ রক্তারক্তি ব্যাপার কখনও ঘটে নাই ; বোধ করি, এইরূপ ধৰ্ম্মগত বিদ্বেষ ভারতবাসীর সম্পূর্ণ স্বভাববহিভূত। ইউরোপের সহিত ভারতবর্ষের তুলনা করিলে, ঐক্যের অভাবে ভারতবাসীকে তিরস্কার করা উচিত হয় না। সমগ্র ইউরোপ এক হয় নাই। উহার অন্তর্গত ক্ষুদ্র খণ্ড রাষ্ট্রগুলি জমাট বাধিয়া এক একটা মহাপ্রতাপ নেশনে পরিণত হইয়াছে। এইরূপে সমগ্র ভারতবর্ষ এক মহারাষ্ট্রে পরিণত না হইয়৷ যদি ক্ষুত্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হইত, তাহা হইলেও ভারতবর্ষের পতন অনিবাৰ্য্য না হইতেও পারিত। এই জন্য আমার বোধ হয়, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় অনৈক্য ; বহুসংখ্যক খণ্ড রাজ্যের অস্তিত্ব পতনের একটা প্রধান কারণ হইলেও প্রধানতম কারণ নহে। ভারতবর্ষ ইউরোপের মত বহু রাষ্ট্রে বিভক্ত হইলেও ভারতবর্ষের পরাধীনতা অনিবাৰ্য্য হইত মা । ভারতবর্ষের পতনের কারণ যে, উহার অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলি নেশনে পরিণত হয় নাই। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অনৈক্য ত ছিলই, কিন্তু প্রত্যেক রাষ্ট্রমধ্যে প্রজাশক্তি রাজশক্তি হইতে বিচ্ছিন্ন ছিল। রাজশক্তি প্রজাশক্তির উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। প্রজা শক্তি হইতে বিচ্ছিন্ন থাকায় রাজশক্তি সম্যকৃ রূপ সামর্থ্য লাভ করিতে পারে নাই। স্নাজার স্থখ দুঃখে প্রজা কখনও সমবেদন দেখায় নাই ।