পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা : সামাজিক ব্যাধি ও তাহার প্রতিকার wo, or হেয় প্রণালী বলিয়া বিবেচিত হইত। তখন গুরু-শিষ্যের মধ্যে অল্পবিধ বিনিময়ের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল ; এক পক্ষে স্নেহ ও প্রীতি, অন্য পক্ষে শ্রদ্ধা ও ভক্তি। উপনয়ন সংস্কারের পর তিব্ৰত মানব যখন ব্রহ্মচারীর ইউনিফরম পরিয়া দেবতাগণের ও আত্মীয়জনের আশীৰ্ব্বচন মস্তকে লইয়া পিতৃভবন হইতে গুরুগৃহে উপস্থিত হইত, তখন সেই কুটারবাসী গম্ভীর অপরিচিত পুরুষ সেই নবীন আগন্তুককে স্নেহপূর্ণ প্রতিপূর্ণ দৃষ্টি দ্বারা অভিষিক্ত করিয়া সম্ভাষণ করিয়া লইতেন ; গুরুগৃহ তখন তাহার পিতৃগৃহে পরিণত হুইত ; শিক্ষাদাতা তখন জন্মদাতার স্থান পরিগ্রহ করিতেন, গুরুপত্নী তখন জননীর স্থান গ্রহণ করিতেন, গুরুপুত্ৰগণ বয়স্তের স্থান ও ভ্রাতার স্থান গ্রহণ করিত। গুরুগৃহে বাসকালে যে সকল জ্ঞানোপদেশ প্রদত্ত হইত, তখন যে সকল শাস্থের অধ্যাপনা হইত, তাহার সহিত আধুনিক শিক্ষার ও আধুনিক শাস্থের তুলনার প্রয়োজন নাই ; যখন সেই পুরাকালের ভারতভূমির বেদধ্বনি মুখরিত ঋষিপরিষৎ, সেই মৃগশিশুকুলের বিচরণভূমি, সেই হোমধেন্থসমূহের বিহারস্থলী, সেই ঋষিকন্যাসেবিত লতাবিতান, সেই নীবারকণাকীর্ণ উল্টজাঙ্গন, সেই শুক-মুখভ্রষ্ট ইঙ্গুদিফল-চিহ্নিত হামল শস্তক্ষেত্র, সেই সমিংকুশ-ফলাহরণ-প্রত্যাগত ঋষিশিষ্যমণ্ডলী যখন মানস নেত্রে প্রতিভাত হয়, তখন সেকালের শিক্ষাপ্রণালীর সহিত একালের বিদ্যাবিপণিসমূহে শিক্ষাবিক্রয় প্রথার তুলনা করিয়া দীর্ঘশ্বাস আপনা হইতে বহির্গত হয়। বর্তমান অধ্যাপনা প্রণালীকে আমি যে বিস্তাবিক্রয় বলিয়া উল্লেখ করিতেছি, তাহার একটা কৈফিয়ং আবখ্যক। বেতন গ্রহণ করিয়া বিদ্যাদান যে একবারে অবৈধ ব্যাপার তাহ। আমি বলিতে চাহি না । অধ্যাপকেরও জীবনধারণ আবশ্বক, এবং অধ্যাপনাই র্যাহার একমাত্র জীবিকা, তাহাকে সেই উপলক্ষ্যেই জীবনোপায় সংগ্ৰহ করিতে হইবে। আধুনিক চতুষ্পাঠীমধ্যে ছাত্রের নিকট বেতন গ্রহণের প্রথা বর্তমান নাই , কিন্তু চতুস্পাঠীর অধ্যাপকেরাও দেশের ধনিক সম্প্রদায় কত্ত্বক এক হিসাবে পারিশ্রমিক পাইয়া থাকেন। দেশে যখন হিন্দু রাজা শাসনদণ্ড পরিচালন করিতেন, তখন তাহার। রাজার ব্যয়েই প্রতিপালিত হইতেন। একালে আর অধ্যাপকের জন্য ভূমিদানের তাম্রশাসন ক্ষোদিত হয় না ; কিন্তু তথাপি চতুষ্পাঠীর অধ্যাপকগণের সামান্য অভাব পিতৃপিতামহ হইতে প্রাপ্ত নিষ্কর ভূসম্পত্তি হইতে ও ধনিসম্প্রদায়ের অনুগ্রহ হইতে পরিপূর্ণ হইয়া থাকে। এইরূপ বন্দোবস্তে যে একেবারে দোষ নাই, তাহাও আমি বলিতে চাহি না । ধনীর অনুগ্রহের উপর জীবিকার জন্য নির্ভর করিয়৷ থাকিতে হইলে অনেকটা আত্মমর্য্যাদার হ্রাস হয় ; এবং ক্রমশঃ চাটুবৃত্তি শিক্ষা অভ্যস্ত হইয়া আসে। আমাদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের মধ্যেও এমন উদাহরণ বিরল নহে, সামান্ত অর্থের জন্য অসার অকৰ্ম্মণ্য জমিদারসন্তানকেও “রাজন, তব ষশো ভাতি দধিবৎ" বলিয়া চাটুকীৰ্ত্তনে কুষ্ঠিত হয়েন না। চতুষ্পাঠীর প্রণালীকে আমর প্রাচীন শিক্ষাপ্রণালীর শেষ অবস্থা বলিয়া মনে করিতে পারি, যখন অধ্যাপকের পালন ও উচ্চশিক্ষা প্রদান রাজার কৰ্ত্তব্য ও সাধারণের কৰ্ত্তব্য, অর্থাৎ “ষ্টেটের কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইত। একালেও সাধারণ শিক্ষার ভার ষ্টেটের লওয়া উচিত কি না, তাহা লইয়া মধ্যে মধ্যে বিতগু উপস্থিত হয় । ও প্রাথমিক শিক্ষার ভার যে ষ্টেটের লওয়া উচিত, সে বিষয়ে বোধ হয় মতদ্বৈধ নাই ।