পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা ; আমিষ ভোজন 8Vう> শাসিত, সমাজের উচ্চতর স্তরে হিংসার প্রতি যতটা বিরাগ আছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও ততটা আছে কি না জানি না। অন্ততঃ এ দেশের বৃহৎ মানবসম্প্রদায় যে ভাবে জীবহিংসা ও আমিষাহার বর্জন করিয়াছে, পৃথিবীর অন্য কোথাও তেমন দেখা যায় না। অথচ ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্মের সহিত অহিংসাধৰ্ম্মের স্থানে স্থানে বিরোধ দেখা যায়। এই ঘটনাটার আরএকটু বিচার অবিশুক । ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল বেদ । বেদ পশুহিংসার বিরোধী নহে। বৈদিক যজ্ঞে পশুহত্যার ব্যবস্থা ছিল। ঋষিরা মাংসভোজী ছিলেন । শুনিতে পাওয়া যায়, একালে যে মাংস হিন্দুর পাতিত্যজনক, ঋষিদের নিকট তাহাও উপাদেয় ছিল । একালে পৌরাণিক ও তান্ত্রিক উপাসনা বৈদিক যজ্ঞের স্থান গ্রহণ করিয়াছে। দেবোদেশে পশুহত্যা এই সকল উপাসনাতে অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। একালে অনেক ব্রাহ্মণসম্প্রদায় মাংস বর্জন করিয়াছেন, অনেকে দেবোদিষ্ট মাংস ভিন্ন অন্য মাংস খান না, তথাপি মাংস ভোজন হিন্দুর বর্জনীয়, এরূপ ব্যবহার নাই । পিতৃশ্ৰাদ্ধে মাংস ব্যবহার অদ্যাপি প্রচলিত। আয়ুৰ্ব্বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রে বিবিধ মাংসের গুণকীৰ্ত্তন ও ব্যাখ্যা আছে। বলা বাহুল্য, ধৰ্ম্মবিরুদ্ধ হইলে আযুৰ্ব্বেদ এরূপ বিধানে সাহসী হইতেন না। শাস্বে স্পষ্ট নিষেধ নাই, স্থানবিশেষে স্পষ্ট ব্যবস্থা আছে ; অথচ ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তি মাংসভোজনের বিরোধী ; এ স্থলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সহিত অহিংসাধৰ্ম্মের সম্বন্ধ বিষয়ে খটকা উপস্থিত হয় । এই খটকা বহু দিন পূর্বেই উপস্থিত হইয়াছিল। অন্ততঃ মল্লসংহিতা ও মহাভারত রচনার সময় শাস্থের সহিত সহজ ধৰ্ম্মের এই বিষয়ে বিরোধ উপস্থিত হইয়াছিল। অহিংসাধৰ্ম্ম বৌদ্ধগণের প্রবত্তিত মনে করিবার সম্যকৃ কারণ নাই। বুদ্ধদেব স্বয়ং মাংসভোজন একেবারে নিষেধ করিয়া যান নাই। শ্রমণসম্প্রদায়মধ্যে মাংসভোজন প্রথা ছিল। একালের বৈদেশিক বৌদ্ধেরা মাংসভোজনে কুষ্ঠিত নহেন। তবে করুণাসিন্ধু ভগবান শাক্যমুনি বৈদিক যজ্ঞে পশুহত্যার নিন্দা করিয়াছিলেন ; এ দেশে অহিংসাধৰ্ম্ম প্রচলনের সহিত র্তাহার সম্বন্ধ অস্বীকার করিলে চলিবে না | মনুসংহিতাকার বড়ই গোলে পড়িয়াছিলেন। তিনি বৈদিক ধৰ্ম্মের পক্ষপাতী ; বৈদিক আচার অব্যাহত রাখিবার জন্য র্তাহার চেষ্টা ; অথচ তাহার মনে বলিতেছে, জীবহত্যা কাজটা ভাল নহে । বৈদিক ব্যবহার লোপে তিনি সাহসী হয়েন নাই ; যজ্ঞাকুষ্ঠান ভিন্ন অন্যত্র জীবহত্যার তিনি নিন্দা করিয়াছেন ; শেষ পর্য্যন্ত বলিয়াছেন—“প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফল।” এই মীমাংসা একালের লোকের পছন্দ হইবে না। একালের লোকে বলিবেন, মনুসংহিতাকার ভীরুতার পরিচয় দিয়াছেন । ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তির আদেশ সত্ত্বেও তিনি প্রাচীন শাস্ত্রের আদেশ লঙ্ঘনে সাহসী হয়েন নাই। একালের যুক্তি যে, ধৰ্ম্মনির্ণয়ে শাস্ত্রের ব্যবস্থা গ্রাহ নহে। সহজ ধৰ্ম্মপ্রবৃত্তি বা কনশেনস যাহা অনুমোদন করিবে, তাহাই গ্রাহ । সমস্ত সমাজসংস্কারকের মুখে এই এক কথা। হিন্দু সমাজ শাস্ত্রের আদেশ লঙ্ঘনে সাহসী হয় না ; কাজেই সংস্কারকগণ হিন্দুসমাজের নিপাত কামনা করেন।