পাতা:লেখন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.djvu/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে এটা ক্ষণিক কালের ফুলের দোষ নয়, চলতে চলতে দেখারই দোষ। যে জিনিষটা বহরে বড়ো নয় তাকে আমরা দাঁড়িয়ে দেখি নে, যদি দেখতুম তবে মেঠো ফুল দেখে খুশি হলেও লজ্জার কারণ থাকত না। তার চেয়ে কুমড়োফুল যে রূপে শ্রেষ্ঠ তা নাও হতে পারে।

 গেলবারে যখন ইটালিতে গিয়েছিলুম, তখন স্বাক্ষরলিপি খাতায় অনেক লিখতে হয়েছিল। লেখা যাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের অনেকেরই ছিল ইংরেজি লেখারই দাবি। এবারেও লিখতে লিখতে কতক তাঁদের খাতায় কতক আমার নিজের খাতায় অনেকগুলি ওইরকম ছোটো ছোটো লেখা জমা হয়ে উঠল। এইরকম অনেক সময়ই অনুরোধের খাতিরে লেখা শুরু হয়, তার পরে রোক চেপে গেলে আর অনুরোধের দরকার থাকে না।

 জার্মানিতে গিয়ে দেখা গেল, এক উপায় বেরিয়েছে তাতে হাতের অক্ষর থেকেই ছাপানো চলে। বিশেষ কালী দিয়ে লিখতে হয় এল্যুমিনিয়মের পাতের উপরে, তার থেকে বিশেষ ছাপার যন্ত্রে ছাপিয়ে নিলেই কম্পোজিটারের শরণাপন্ন হবার দরকার হয় না।

 তখন ভাবলেম, ছোটো লেখাকে যাঁরা সাহিত্য হিসাবে অনাদর করেন তাঁরা কবির স্বাক্ষর হিসাবে হয়তো সেগুলোকে গ্রহণ করতেও পারেন। তখন শরীর যথেষ্ট অসুস্থ, সেই কারণে সময় যথেষ্ট হাতে ছিল, সেই সুযোগে ইংরেজি বাংলা এই ছুটকো লেখাগুলি এল্যুমিনিয়ম পাতের উপর লিপিবদ্ধ করতে বসলুম।

 ইতিমধ্যে ঘটনাক্রমে আমার কোনো তরুণ বন্ধু বললেন, ‘আপনার কিছুকাল পূর্বেকার লেখা কয়েকটি ছোটো ছোটো কবিতা আছে। সেইগুলিকে এই উপলক্ষে যাতে রক্ষা করা হয় এই আমার একান্ত অনুরোধ।’

 আমার ভোলবার শক্তি অসামান্য এবং নিজের পূর্বের লেখার প্রতি প্রায়ই আমার মনে একটা অহেতুক বিরাগ জন্মায়। এই জন্যই তরুণ লেখকরা সাহিত্যিক পদবী থেকে আমাকে যখন বরখাস্ত করবার জন্যে কানাকানি করতে থাকেন তখন আমার মন আমাকে পরামর্শ দেয় যে, ‘আগেভাগে নিজেই তুমি মানে মানে রেজিগ্‌নেশন-পত্র পাঠিয়ে যৎসামান্য কিছু পেন্‌সনের দাবি রেখে দাও।’ এটা যে সম্ভব হয় তার কারণ আমার পূর্বেকার লেখাগুলো আমি যে পরিমাণে ভুলি সেই পরিমাণেই মনে হয় তারা ভোলবারই যোগ্য।

 তাই প্রস্তুত হয়েছিলেম, আমার বন্ধু পুরোনো ইতিহাসের ক্ষেত্র থেকে উঞ্ছস্বরূপ যা-কিছু সংগ্রহ করে আনবেন আবার তাদেরকে পুরোনোর তমিস্রলোকে বৈতরণী পার করে ফেরত পাঠাব।

 গুটিপাঁচেক ছোটো কবিতা তিনি আমার সম্মুখে উপস্থিত করলেন। আমি বললেম ‘কিছুতেই মনে পড়বে না এগুলি আমার লেখা’, তিনি জোর করেই বললেন, ‘কোনো সংশয় নেই।’

 আমার রচনা সম্বন্ধে আমার নিজের সাক্ষ্যকে সর্বদাই অবজ্ঞা করা হয়। আমার গানে আমি সুর দিয়ে থাকি। যাকে হাতের কাছে পাই তাকে সেই সদ্যোজাত সুর শিখিয়ে