পাতা:লোকরহস্য-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪৬
লোকরহস্য

জামাইবাবুর উপর বড় খুসি হইয়া অন্তঃপুরে গিয়া বলিল, “জামাইবাবুর বিবেচনা ভাল—সঙ্গের মানুষটি না খেলে কি তিনি খেতে পারেন— তা আগে তাঁকে জল খাওয়াও, তবে জামাই খাবেন।”

 বাড়ীর গৃহিণী মনে ভাবিলেন, “সে উপরি লোক, তাহাকে বাড়ীর ভিতরে আনিয়া জল খাওয়ান হইতে পারে না। জামাইকেও বাহিরে খাওয়ান হইতে পারে না। তা, তার যায়গা হউক বাহিরে, আর জামাইয়ের যায়গা হউক ভিতরে।” গৃহিণী সেইরূপ বন্দোবস্ত করিলেন। রামা বাহিরে জলযোগের উদ্যোগ দেখিয়া বড় ক্রুদ্ধ হইল, ভাবিল, “এ কি অলৌকিকতা?” এদিকে দাসী কালীকান্তকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া আনিল। ঘরের ভিতর স্থান হইয়াছে, কিন্তু কালীকান্ত উঠানে দাঁড়াইয়া বলিল, “আমাকে ঘরের ভিতর কেন? আমাকে এইখানে হাতে দুটো ছোলা গুড় দাও, খেয়ে একটু জল খাই।” শুনিয়া শালীরা বলিল, “বোসজা মশাই যে, এবার অনেক রকম রসিকতা শিখে এয়েছ দেখতে পাই।” কালীকান্ত কাতর হইয়া বলিল, “আজ্ঞে আমাকে ঠাট্টা করেন কেন, আমি কি আপনাদের তামাসার যোগ্য?” একজন প্রাচীনা ঠাকুরাণীদিদি বলিল, “আমাদের তামাসার যোগ্য কেন? —যার তামাসার যোগ্য, তার কাছে চল।” এই বলিয়া কালীকান্তের হাত ধরিয়া হড়হড় করিয়া টানিয়া ঘরের ভিতর লইয়া আসিল।

 সেখানে কালীকান্তের ভার্য্যা কামসুন্দরী দাঁড়াইয়া ছিল। কালীকান্ত তাহাকে দেখিয়া প্রভুপত্নী মনে করিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল।

 কামসুন্দরী দেখিয়া, চন্দ্রবদনে মধুর হাসি হাসিয়া বলিল, “ওকি ও রঙ্গ—এ আবার কোন্ ঠাট শিখিয়া আসিয়াছ?” শুনিয়া কালীকান্ত কাতর হইয়া কহিল, “আজ্ঞে, আমার সঙ্গে অমন সব কথা কেন—আমি আপনার চাকর-আপনি মুনিব।”

 রসিকা কামসুন্দরী বলিল, “তুমি চাকর, আমি মুনিব, সে আজ না কাল? যত দিন আমার বয়স আছে, তত দিন এই সম্পর্কই থাকিবে। এখন জল খাও।”

 কালীকান্ত মনে করিল, “বাবা, এঁর কথার ভাব যে কেমন কেমন। আমাদের বাবু যে একটা গেছো মেয়ের হাতে পড়েছেন দেখতে পাই। তা আমার সরাই ভাল।” এই ভাবিয়া কালীকান্ত পুনর্ব্বার ভক্তিভাবে প্রণাম করিয়া পলাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, দেখিয়া কামসুন্দরী আসিয়া তাঁহার গাত্রবস্ত্র ধরিল; বলিল, “ওরে আমার সোণার চাঁদ! আমার সাত রাজার ধন এক মাণিক। আমার কাছ থেকে আর পলাতে হয় না।” এই বলিয়া কামসুন্দরী স্বামীকে আসনের দিকে টানিতে লাগিল।