পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দশম সম্ভার).djvu/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিলাসী মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়ো-বাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম, তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙা বারান্দার একধারে রুটি গড়িতেছিল, অকস্মাং লাঠি-সোট হাতে এতগুলি লোককে উঠানের উপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া গেল । খুড়া ঘরের মধ্যে উকি মারিয়া দেখিলেন, মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া, সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু করিলেন। বলা বাহুল্য, জগতের কোন খুড়া কোনকালে বোধ করি ভাইপোর স্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই । সে এমনি যে, মেয়েটি হীন সাপুড়ের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিয়া বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকে দিয়েচে জানো ! খুড়া বলিলেন, তবে রে ! ইত্যাদি ইত্যাদি— এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বায়োজন বীরদৰ্পে হুঙ্কার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল । কেহ ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিল হাত-দুটো—এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না, তাহারাও নিশ্চেষ্ট হইয়ারহিলনা। কারণ, সংগ্রাম-স্থলে আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি, আমাদের বিরুদ্ধে অতবড় দুর্নাম রটনা করিতে বোধ করি নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ হইবে। এইখানে একটা অবাস্তর কথা বলিয়া রাখি । শুনিয়াছি, নাকি বিলাত প্রভৃতি মেচ্ছদেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুৰ্ব্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কি কথা! সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি, যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নর-নারী যাই হোক না কেন। মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপরে একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে গ্রামের বাহিরে রাখিয়া আসিবার জন্য হিচড়াইয়া লইয়া চলিলাম, তখন সে মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, বাবুরা আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও, আমি রুটিগুলো ঘরে দিয়ে আসি। বাইরে শিয়াল-কুকুরে খেয়ে যাবে—রোগ-মানুষ সমস্ত রাত খেতে পাবে না। মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মত মাথা কুটিতে লাগিল, স্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং প্রাব্য-অশ্ৰাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল । কিন্তু আমরা তাহাতে তিলাৰ্দ্ধ বিচলিত হইলাম না । স্বদেশের মঙ্গলের জন্য সমস্ত অকাতরে সঙ্ক করিয়া তাহাকে হিড় হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিলাম । চলিলাম বলিতেছি, কেননা আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে একটুখানি দুৰ্ব্বলতা ছিল, আমি তাহার গায়ে হাত দিতে পারি নাই। বরঞ্চ কেমন ষেন কাল্প পাইতে লাগিল ; সে যে অভ্যস্ত অস্কায় করিয়াছে এবং তাহাকে ર૭.8