পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দ্বাদশ সম্ভার).djvu/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ একদিন নতুন-মাই নিজে—তাদেরই মধ্যে। কেবল আমাকেই যে একদিন যাবে বাবা আমার কাছে ? বলে ঘরে ডেকে এনেছিলেন তাই নয়, এনেছিলেন আরও অনেককেই। এ ছিল তার স্বভাব। তাই পিসতুতো বোন গেল চলে, কিন্তু পিসি রইলেন তার শোধ নিতে । তারক শুধু ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল। রাখাল কহিল, ইতিমধ্যে চক্রান্ত যে কত নিবিড় ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল তারই খবর পেলাম অকস্মাৎ একদিন গভীর রাতে । কি একপ্রকার চাপ-গলার কর্কশ কোলাহলে ঘুম ভেঙে ঘরের বাইরে এসে দেখি মুমুখের ঘরের কপাটে বাইরে থেকে শিকল দেওয়া। উঠানের মাঝখানে গোটা পাচছয় লণ্ঠন। বারান্দার একধারে বসে স্তন্ধ অধোমুখে ব্ৰজবাবু এবং সেই ঘরের সামনে দাড়িয়ে নবীনবাবু—কর্তার খুড়তুতো ছোট ভাই—রুদ্ধারে অবিরত ধাক্কা দিয়ে কঠিন কণ্ঠে পুনঃ পুন: হাকচেন, রমণীবাবু, দোর খুলুন। ঘরটা আমরা দেখব। বেরিয়ে আক্ষন বলচি । ইনি কলকাতার আড়ত থেকে হাজার কুড়ি-পঁচিশ টাকা উড়িয়ে কিছুকাল হোলো বাড়িতে এসে বসেচেন । বাড়ির মেয়েরা বারান্দার আশে-পাশে দাড়িয়ে মনে হোলো চাকররা কাছাকাছি কোথাও যেন আড়ালে অপেক্ষ করে আছে –ব্যাপারটা ঘুম-চোখে প্রথমটা ঠাওর পেলাম না, কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত বুঝলাম। এখনি ভীষণ কি-একটা ঘটবে ভেবে ভয়ে সৰ্ব্বাঙ্গ ঘামে ভেসে গেল, চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো ; হয়ত মাথা ঘুরে সেইখানে পড়ে যেতাম, কিন্তু তা আর হোলো না । দোর খুলে রমণীবাবুর হাত ধরে নতুন-ম বেরিয়ে এলেন । বললেন, তোমরা কেউ এর গায়ে হাত দিয়ে না, আমি বারণ করে দিচ্ছি। আমরা এখুনি বাড়ি থেকে বার হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ যেন একটা বজ্ৰাঘাত হয়ে গেল। একি সত্য-সত্যই এ-বাড়ির নতুন-মা ! কিন্তু তাদের অপমান করবে কি, বাড়িমৃদ্ধ সকলে লজ্জায় মরে গেল। যে যেখানে ছিল সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে—র্তারা সদর দরজা যখন পার হয়ে যান, কর্তা তখন অকস্মাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, নতুন-বোঁ, তোমার রেণু রইল যে ? কাল তাকে আমি কি দিয়ে বোঝাব ! নতুন-মা একটা কথাও বললেন না, নিঃশব্দে ধীরে ধীরে বার হয়ে গেলেন। সেদিন সেই রেণু ছিল তিন বছরের আজ বয়স হয়েচে তার ষোল। এই তেরো বছর পরে আজ হঠাৎ দেখা দিলেন মা, মেয়েকে বিপদ থেকে বঁাচাবার জন্ত । এইবার এতক্ষণ পরে কথা কহিল তারক—নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আর এই তেরোটা বছর মেয়েকে মা চোখের আড়াল করেননি। এবং শুধু মেয়েই নয়, খুব সম্ভব, তোমাদের কাউকেই মা ।