পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দ্বিতীয় সম্ভার).djvu/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্ত্রীকান্ত সৰ্ব্বস্ব দিয়া সংসার উপভোগ করিবার সেই উত্তপ্ত আবেগ আর রাজলক্ষ্মীর মধ্যে নাই ; আজ সে শান্ত, স্থির। তাহার কামনা-বাসনা আজ তাঁহারই মধ্যে এমন ভুব মারিয়াছে যে, বাহির হইতে হঠাৎ সন্দেহ হয় তাহারা আছে, কি নাই। তাহাই এই সামান্য ঘটনাকে উপলক্ষ করিয়া আমাকে আবার স্মরণ করাইয়া দিল, আজ এই তাহার পরিণত যৌবনের স্থগভীর তলদেশ হইতে যে মাতৃত্ব সহসা জাগিয়া উঠিয়াছে, সন্তনিদ্রোথিত কুম্ভকর্ণের মত তাহার বিরাট ক্ষুধার আহার মিলিবে কোথায় ? তাহার নিজের সস্তান থাকিলে যাহা সহজ এবং স্বাভাবিক হইয়া উঠিতে পারিত তাহারই অভাবে সমস্ত এমন একান্ত জঠিল হইয়া উঠিয়াছে। সেদিন পাটনায় তাহার মধ্যে যে মাতৃরূপ দেখিয়া মুগ্ধ অভিভূত হইয়া গিয়াছিলাম, আজ তাহার সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আমার অত্যন্ত ব্যথার সহিত কেবলি মনে হইতে লাগিল, তত বড় আগুনকে ফু দিয়া নিভানো যায় না বলিয়াই আজ পরের ছেলেকে ছেলে কল্পনা করার ছেলে-খেলা দিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকের তৃষ্ণ কিছুতেই মিটিতেছে না। তাই আজ একমাত্র বন্ধুই তাহার কাছে পর্যাপ্ত নয়, আজ দুনিয়ার যেখানে যত ছেলে আছে, সকলের মুখ-দুঃখই তাহার হৃদয়কে আলোড়িত করিতেছে। বৰ্দ্ধমানে ভদ্রলোক নামিয়া গেলে রাজলক্ষ্মী অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল। আমি জানাল হইতে দুষ্ট সরাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, এই কান্নাটা কার কল্যাণে হ’লো ? সরল, না তার মায়ের ? রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া কহিল, তুমি বুঝি এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিলে ? বলিলাম, কাজে কাজেই । মানুষ নিজে কথা না কইলেই পরের কথা তার কানে এসে ঢোকে। সংসারে কম কথার লোকের জন্যে ভগবান এই শান্তির স্মৃষ্টি করে রেখেছেন। ফাকি দেবার জো নেই। সে যাক, কিন্তু চোখের জল কার জন্তে করছিল শুনতে পাইনে ? রাজলক্ষ্মী কহিল, আমার চোখের জল কার জন্তে ঝরে, সে শুনে তোমার লাভ নেই। < কহিলাম, লাভের আশা করিনে—শুনে লোকসান বাচিয়ে চলতে পারলেই বাচি । সরল কিংবা তাহার মায়ের জন্য যত ইচ্ছে চোখের জল ঝরুক, আমার আপত্তি নেই, তার বাপের জন্যে বরাট আমি পছন্দ করিনে। রাজলক্ষ্মী শুধু একটা ‘ই’ বলিয়াই জানালার বাহিরে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। মনে করিয়াছিলাম, এমন একটা রসিকতা নিষ্ফল হইবে না, ইহা অনেক নিরুদ্ধ উৎসের বাধা মুক্ত করিয়া দিবে। কিন্তু সে ত হইলই না, বরঞ্চ যদি বা সে এতক্ষণ এইদিকেই চাহিয়াছিল, রসিকতা শুনিয়া আর-এক দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল। e: