পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী মাত্র পাঁচদিন চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিয়াছেন, এইটুকু সময়ের অনাচার ও অত্যাচারে সমস্ত গ্রামখানা যেন জ্বলিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। নজরের টাকাও আদায় হইতেছে, কিন্তু সে যে কি করিয়া হইতেছে তাহা জমিদার-সরকারে চাকরি না করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করাও পাগলামি।

 তারাদাস চক্রবর্তী আদেশমত প্রথম দিন হাজির হইয়া নজর দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন, এমন কি ছয় ঘণ্টাকাল তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খাড়া দাঁড়াইয়াও স্বীকার করেন নাই। কিন্তু সর্বসমক্ষে কান ধরিয়া ওঠ-বোস, ঘোড়দৌড় এবং ব্যাঙের নাচ নাচাইবার প্রস্তাবে আর ধৈর্য রক্ষা করিতে পারেন নাই। চণ্ডীমাতার নিকট কায়মনে জমিদারগোষ্ঠীর বংশলোপের আবেদন করিয়া, প্রকাশ্যে পাঁচদিনের কড়ারে টাকা আদায় দিবার অঙ্গীকারে অব্যাহতি পাইয়া বাড়ি আসেন। আজ সেই দিন, কিন্তু সকাল হইতে কোথাও তাঁহাকে দেখা যাইতেছে না।

 ইতিমধ্যে প্রত্যহ মহাপ্রসাদ যোগাইতে হইয়াছে; পুকুরের মাছ, বাগানের ফলমূল, চালের লাউ-কুমড়া জমিদারের লোক যথেচ্ছা টানিয়া ছিঁড়িয়া লইয়া গিয়াছে—ষোড়শী প্রতিবাদ করিতে চাহিয়াছে, কিন্তু তারাদাস কিছুতেই একটা কথাও কহিতে দেয় নাই, তাহার হাতে ধরিয়া কাঁদাকাটা করিয়া যেমন করিয়া হোক নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে। পিতার অপমান হইতে আরম্ভ করিয়া এই-সকল নির্যাতন সে কোনমতে এতদিন সহিয়াছিল, কিন্তু আজিকার ঘটনায় তাহার সমস্ত সঞ্চিত ক্রোধ একমুহূর্তে অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। পিতার নিঃশব্দ অন্তর্ধানের হেতু ও তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের ভার তাহার মন একাকী যেন আজ আর বহিতে পারিতেছিল না। এমনি করিয়া সমস্ত সকাল ও মধ্যাহ্ন যখন অপরাহ্নে গড়াইয়া পড়িল, তখন রাত্রের অন্ধকারে উপবাসী পিতার গোপনে ফিরিয়া আসার প্রত্যাশা করিয়া সে দুটো রাঁধিতে বসিয়াছিল, এমন সময়ে মন্দিরের পরিচারিকা আসিয়া যে অত্যাচার বর্ণনা করিল, তাহা এই—

 মাতাল ভূস্বামীর হঠাৎ খেয়াল হইয়াছে যে, অতঃপর নিষিদ্ধ মাংস ত নহেই, এমন কি বৃথা মাংসও ভোজন করিবেন না। অথচ পাঁঠার মাংস যথেষ্ট সুস্বাদু বা রুচিকর নহে। তাই আজ জমিদারের লোক ডোমপাড়া হইতে একটা খাসি আনিয়া মন্দিরে হাজির করে এবং তাহাকে মহাপ্রসাদ করিয়া দিতে বলে। পুরোহিত প্রথমটা আপত্তি করে, কিন্তু শেষে আদেশ শিরোধার্য করিয়া উহাকেই উৎসর্গ করিয়া যথারীতি বলি দিয়া দেবীর মহাপ্রসাদ করিয়া দেয়।