পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শরৎ-সাহিত্য-সংগ্রহ

 কে বোতাম লইয়াছে, সেজদাদা বুঝিয়াছিলেন। গরীব গদাধরের উপর কোনও জুলুম হইল না। কিন্তু আমিও সেই অবধি প্রতিজ্ঞ করিলাম, আর কখনও এমন কর্ম্ম করিয়া অন্যকে বিপন্ন করিব না।

 এরূপ প্রতিজ্ঞ আমি পূর্ব্বে কখনও করি নাই, কখনও করিতাম কি না জানি না। শুধু গদাধর আমাকে একেবারে মাটি করিয়া দিয়াছে।

 কি উপায়ে কাহার যে চরিত্র সংশোধিত হইয়া যায়, কেহই জানে না। গুরুমহাশয়ের, ঠাকুর্দ্দা মহাশয়ের, আরও অনেক মহাশয়ের কত চেষ্টাতেও আমি যে প্রতিজ্ঞা কখনও করি নাই, এক গদাধর ঠাকুরের মুখ মনে করিয়া আজ সেই প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিলাম। এতদিনে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইয়াছে কি-না জানি না; কিন্তু স্বেচ্ছায় কখনও ভঙ্গ করিয়াছি এমন মনে হয় না।

 এখন আর একজন লোকের কথা বলি। সে আমাদের রামা চাকর। রামা জাতে কায়েত কি সদ্‌গোপ, এমনই কি একটা ছিল। বাড়ি কোথায়, শুনি নাই— এত হুঁশিয়ার চটপটে চাকর সর্ব্বদা দেখা যায় না। আর যদি কখনও দেখা হয়, ইচ্ছা আছে, তাহার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়া লইব।

 সকল কর্ম্মে রামাকে চরকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতে দেখিতাম। এই রামা কাপড় কাচিতেছে; তখনি দেখি সেজদাদা স্নানে বসিয়াছেন, সে গা রগড়াইয়া দিতেছে; পরক্ষণেই দেখি সে পান-সুপারি লইয়া মহা ব্যস্ত। এইরূপে সে সর্ব্বদাই ঘুরিয়া বেড়ায়। সেজদার “The favourite!” মস্ত লোক। আমি কিন্তু তাহাকে দেখিতে পারিতাম না। সে-বেটার জন্য আমি সেজদার নিকট প্রায়ই তিরস্কৃত হইতাম। বিশেষতঃ গদা বেচারীকে সে সর্ব্বদাই অপ্রস্তুত করিত। আমি তাহার উপর বড় চটা ছিলাম। কিন্তু হইলে কি হয়, সে সেজদার “The favourite!” আমাদের বাসার রামবাবুও তাহাকে দেখিতে পারিতেন না। তিনি বলিতেন, “The rogue!” তখন এ-কথাটার ব্যাখ্যা তিনি নিজে না করিতে পারিলেও আমরা দুজনে বিলক্ষণ বুঝিতাম, রাম “The rogue!” তাহার চটিবার আরও অনেক কারণ ছিল। প্রধান কারণ এই যে, সে নিজেকে রামবাবু বলিয়া পরিচিত করিত। সেজদাদাও সময়ে সময়ে রামবাবু বলিয়া ডাকিতেন। আমাদের রামবাবুর এ-সব ভাল লাগিত না। যাক বাজে কথা –

 একদিন বিকালে সেজদাদা একটা ল্যাম্প ক্রয় করিয়া আনিলেন। বড় ভাল জিনিস, প্রায় পঞ্চাশ-যাট টাকা মূল্য। সকলে বেড়াইতে যাইলে আমি গদাধরকে ডাকিয়া আনিয়া সেটা দেখাইলাম। গদাধর সে-রকম আলো কখনও দেখে নাই। সে মহা আহ্লাদিত হইয়া সেটা দুই-চারিবার নাড়িয়া দেখিল; তাহার পর আপনার কর্ম্মে রন্ধনশালার প্রবেশ করিল। আমার কিন্তু কৌতুহল কিছুতেই থামিল না।

৩১৬