আমি তখন ছেলেমানুষ ছিলাম। নিতান্ত ছেলে-বুদ্ধিতে সেই হুঁকোটিকে বুকে টিপিয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কেন যে, তাহার কারণ বুঝিতে পারি না।
আমার আর সে বাসাতে মন টিকিত না। সন্ধ্যার সময় ঘুরিয়া ফিরিয়া একবার করিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিতাম। আর একজন রাঁধিতেছে দেখিয়া অন্যমনে আপনার ঘরে আসিয়া বই খুলিয়া পড়িতে বসিতাম। সময় সময় আমার সেজদাদাকেও দেখিতে পাইতাম না। ভাত পর্য্যন্ত আমার তিক্ত বোধ হইত। অনেকদিন পরে একদিন রাত্রে সেজদাদাকে বলিলাম, সেজদা! কি করেচ?
কিসের কি করেচি?
গদা তোমার টাকা কখনো চুরি করেনি।
সকলেই জানিত আমি গদা ঠাকুরকে বড় ভালবাসিতাম। সেজদাদা বলিলেন, ভাল করিনি সুকুমার। যা হবার হয়েছে, কিন্তু রামাকে তুই অত মেরেছিলি কেন?
বেশ করেছিলাম। আমাকেও কি তাড়াবে নাকি?
দাদা আমার মুখে কখনও আমন কথা শোনেন নাই। আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমার কত টাকা উসুল হয়েচে?
দাদা বড় দুঃখিত হইয়া বলিলেন, ভাল করিনি। সব টাকা তার কেটে নিয়ে আড়াই টাকা উসুল করেছিলাম। আমার এতটা ইচ্ছে ছিল না।
আমি যখন রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম, দুরে যদি কোনও লোক ময়লা চাদর কাঁধে ফেলিয়া ছেঁড়া চটিজুতা-পায়ে চলিয়া যাইত, আমি দৌঁড়াইয়া গিয়া দেখিয়া আসিতাম। কি যে একটা আশা নিত্য নিরাশায় পরিণত হইত, তাহা আর কি বলিব?
প্রায় পাঁচ মাস পরে দাদার নামে একটা মণি-অর্ডার আসিল। দেড় টাকার মণি-অর্ডার। দাদাকে আমি সেইদিন চোখের জল মুছিতে দেখি। সে কুপনটা এখনও আমার নিকট রহিয়াছে।
কত বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। আজও সেই গরীব গদাধর ঠাকুর আমার বুকের আধখানা জুড়িয়া বসিয়া আছে।