পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেনা-পাওনা এত রাগ, সে-দশা আমার ত আমি নিজেই করেচি। আমি ত নিজের ইচ্ছামতেই বাবাকে ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েচি । সাগর কহিল, কিন্তু এতকাল ত এ আশ্রয় নেবার ইচ্ছে হয়নি মা ! একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া অকস্মাৎ তাহার কণ্ঠস্বর যেন উগ্র ও উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, কহিল, তারাদাস ঠাকুরের ওপরও আমাদের রাগ নেই, রায়মশায়কেও আমরা কেউ কিছু বলব না, কিন্তু জমিদারকে আমরা সুবিধে পেলে সহজে ছাড়ব না। জান মা, আমাদের বিপিনের সে কি করেচে ? সে বাড়ি ছিল না তার লোকজন তার ঘরে ঢুকে – ষোড়শী তাড়াতাড়ি তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল, থাক সাগর, ওসব খবর আর তোরা আমাকে শোনাস্নে । সাগর চুপ করিল। ষোড়শী নিজেও বহুক্ষণ পৰ্য্যন্ত আর কোন প্রশ্ন করিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সাগর পুনরায় যখন কথা কহিল, তাহার কণ্ঠস্বরে মৃঢ় বিস্ময়ের আভাস ষোড়শী স্পষ্ট অনুভব করিল। সাগর কহিল, ম, আমরা তোমার প্রজা, আমাদের দুঃখ তুমি না শুনলে শুনবে কে ? ষোড়শী কহিল, কিন্তু শুনেও ত অতবড় জমিদারের বিরুদ্ধে আমি প্রতিকার করতে পারব না বাছা । সাগর কহিল, একবার ত করেছিলে। আবার যদি দরকার হয়, তুমিই পারবে । তুমি না পারলে আমাদের রক্ষা করতে কেউ নেই মা ! ষোড়শী বলিল, নতুন ভৈরবী যদি কেউ হয় তাকেই তোদের দুঃখ জানাস্। সাগর চমকিয়া কহিল, তাহলে তুমি কি আমাদের সত্যিই ছেড়ে যাবে মা ! গ্রামগুদ্ধ সবাই যে বলাবলি করচে—সে সহসা থামিল, কিন্তু ষোড়শী নিজেও এ প্রশ্নের হঠাৎ উত্তর দিতে পারিল না। কয়েক মুহূৰ্ত্ত নীরবে থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল, দেখ, সাগর, তোদের কাছে এ-কথা তুলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যায়। কিন্তু আমার সম্বন্ধে সব ত শুনেচিস্ ? গ্রামের আরও দশজনের মত তোরা নিজেও দেখচি বিশ্বাস করেচিস্, তার পরেও কি তোরা আমাকেই মায়ের ভৈরবী করে রাখতে চাস্ রে ? বাহিরে বসিয়া সাগর আস্তে আস্তে উত্তর দিল, অনেক কথাই শুনি মা, এবং আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনে কেনই বা তুমি সে রাত্রে ধরে ফিরলে না, আর কেনই বা সকালবেলা সাহেবের হাত থেকে হুজুরকে বাচালে ! কিন্তু সে যাই হোক মা, আমরা ক’ঘর ছোট-জাত ভূমিজ তোমাকেই মা বলে জেনেচি } যেখানেই যাও আমরাও সঙ্গে যাব । কিন্তু যাবার আগে একবার জানিয়ে দিয়ে যাব ।