পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করে নিলেন—তাঁর মঙ্গল-ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার এতটুকু নালিশ নেই; কিন্তু সে যে আমাকে কি করে রেখে গেছে, আমার বাইরে দেখে সে আপনারা অনুমান করতেও পারবেন না। যদিচ আমাদের সাক্ষাতের দিন প্রতিদিন নিকটবর্তী হয়ে আসচে, সে আভাস আমি প্রতিমুহূর্তেই পাই, তবুও সেই একমাত্র ও অদ্বিতীয় নিরাকার ব্রহ্মের শ্রীচরণে এই প্রার্থনা করি, তিনি তাঁর অসীম করুণায় সেই দিনটিকে যেন আরও সন্নিকটবর্তী করে দেন। এই বলিয়া তিনি জামার হাতায় চোখের কোণটা মুছিয়া ফেলিলেন। অতঃপর কিছুক্ষণ আত্ম-সমাহিত ভাবে মৌন থাকিয়া পুনরায় অপেক্ষাকৃত প্রফুল্ল-কণ্ঠে কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহাদের বাল্যের খেলাধূলা, কিশোর বয়সের পড়াশুনা—তারপর যৌবনে সত্যধর্ম গ্রহণের ইতিহাস বিবৃত করিয়া কহিলেন, কিন্তু বনমালীর কোমল হৃদয়ে গ্রামের অত্যাচার সহ্য হল না—তিনি কলকাতায় চলে গেলেন। কিন্তু আমি সমস্ত নির্যাতন সহ্য করে গ্রামে থাকতেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। উঃ—সে কি নির্যাতন! তথাপি মনে মনে বললাম, সত্যের জয় হবেই। তাঁর মহিমায় একদিন জয়ী হবই। সেই শুভদিন আজ সমাগত—তাই এখানে এতকাল পরে আপনাদের পদধূলি পড়ল। বনমালী আমাদের মধ্যে আজ নেই—দু’দিন পূর্বেই তিনি চলে গেছেন; কিন্তু আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ওই, তিনি উপর থেকে আনন্দে মৃদু মৃদু হাস্য করচেন। এই বলিয়া তিনি পুনরায় মুদিত নেত্রে স্থির হইলেন।

উপস্থিত সকলের মনই উত্তেজিত হইয়া উঠিল—বিজয়ার দু’চক্ষে অশ্রু টলটল করিতে লাগিল। রাসবিহারী চক্ষু মেলিয়া সহসা দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, ওই তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়া। পিতার সর্বগুণের অধিকারিণী—কিন্তু কর্তব্যে কঠোর! সত্যে নির্ভীক! স্থির! আর ঐ আমার পুত্র বিলাসবিহারী। এমনি অটল, এমনি দৃঢ়চিত্ত। এরা বাহিরে এখনও আলাদা হলেও অন্তরে—হ্যাঁ, আর একটি শুভদিন আসন্ন হয়ে আসচে যেদিন আবার আপনাদের পদধূলির কল্যাণে এঁদের সম্মিলিত নবীন-জীবন ধন্য হবে।

একটি অস্ফুট মধুর কলরবে সমস্ত সভাটি মুখরিত হইয়া উঠিল। যে মহিলাটি পাশে বসিয়া ছিলেন, তিনি বিজয়ার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া একটু চাপ দিলেন। রাসবিহারী একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, ঐ তাঁর একমাত্র সন্তান—এটি তাঁর চোখে দেখে যাবার বড় সাধ ছিল; কিন্তু সমস্ত অপরাধ আমার। আজ আপনাদের সকলের কাছে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করচি—এর জন্যে দায়ী আমি একা। পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দুর মত যে মানব-জীবন, এ