পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/২৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পা দিতেই কালীপদ তাড়াতাড়ি আসিয়া কহিল, মায়ের বড় জ্বর বাবু, আপনি একেবারে ওপরে চলুন।

নরেন্দ্র বিজয়ার ঘরে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন সে প্রবল জ্বরে শয্যায় পড়িয়া ছটফট করিতেছে। কে একজন প্রৌঢ়া নারী ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া শিয়রের কাছে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছে এবং অদূরে চৌকির উপর পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী মুখ ভয়ানক গম্ভীর করিয়া বসিয়া আছেন। উভয়ের কাহারই চিত্ত যে ডাক্তারের আগমনে আশায় ও আনন্দে নাচিয়া উঠিল না তাহা না বলিলেও চলে।

বিলাসবিহারী ভূমিকার লেশমাত্র বাহুল্য না করিয়া সোজা জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নাকি পরশু এসে বসন্তের ভয় দেখিয়ে গেছেন?

কথাটা এতবড় মিথ্যা যে হঠাৎ কোন জবাব দিতেই পারা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন শুনিয়া বিজয়া রক্তচক্ষু মেলিয়া চাহিল। প্রথমটা সে যেন ঠাহর করিতে পারিল না; তাহার পরে দুই বাহু বাড়াইয়া কহিল, আসুন।

নিকটে আর কোন আসন না থাকায় নরেন তাহার শয্যার একাংশে গিয়াই উপবেশন করিল। চক্ষের পলকে বিজয়া দুই হাত দিয়া সজোরে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, কাল এলে ত আজ আমার এত জ্বর হতো না—আমি সমস্ত দিন পথ পানে চেয়েছিলাম।

নরেন্দ্র ডাক্তার—তাহার বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, প্রবল জ্বর উগ্র নেশার মত অনেক আশ্চর্য কথা মানুষের ভিতর হইতে টানিয়া আনে; কিন্তু সুস্থ অবস্থায় তাহার অস্তিত্ব, না মুখে না অন্তরে কোথাও হয়ত থাকে না। কিন্তু অনতিদূরে বসিয়া দুর্ভাগ্য পিতা-পুত্রের মাথায় চুল পর্যন্ত ক্রোধে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। নরেন সহজে সান্ত্বনার স্বরে প্রসন্নমুখে কহিল, ভয় কি, জ্বর দু’দিনেই ভাল হয়ে যাবে।

তাহার হাতখানা বিজয়া একেবারে বুকের উপর টানিয়া লইয়া একান্ত করুণসুরে কহিল, কিন্তু আমি ভাল না-হওয়া পর্যন্ত তুমি কোথাও যাবে না বল—তুমি চলে গেলে আমি হয়ত বাঁচব না।

জবাব দিতে গিয়া নরেন মুখ তুলিতেই দুইজোড়া ভীষণ চক্ষুর সহিত তাহার চোখাচোখি হইয়া গেল। দেখিল, একান্ত সন্নিকটবর্তী নিঃশঙ্কচিত্ত শিকারের উপর লাফাইয়া পড়িবার পূর্বাহ্নে ক্ষুধিত ব্যাঘ্র যেমন করিয়া চাহে, ঠিক তেমনি দুই প্রদীপ্ত চক্ষু মেলিয়া বিলাসবিহারী তাহার প্রতি চাহিয়া আছে।