পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিজয়া নিজে শয্যাগত হইয়াও তাঁহাকে বিস্মৃত হয় নাই; সে-ই অনুরোধ করিয়া পাঠাইয়া দিয়াছে শুনিয়া কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে দয়ালের চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে এই নবীন চিকিৎসক ও প্রাচীন আচার্যের মধ্যে আলাপ জমিয়া উঠিল।নরেন্দ্রর চিত্তের মাঝে আজ অনেকখানি গ্লানি জমা হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু এই বৃদ্ধের সন্তোষ, সহৃদয়তা ও অন্তরের শুচিতার সংস্পর্শে তাহার অর্ধেক পরিষ্কার হইয়া গেল। কথায় কথায় সে বুঝিল, এই লোকটির ধর্মসম্বন্ধীয় পড়াশুনা যদিচ নিতান্তই যৎসামান্য, কিন্তু ধর্ম বস্তুটিকে বৃদ্ধ বুক দিয়া ভালবাসেন এবং সেই অকৃত্রিম ভালবাসায়ই যেন ধর্মের সত্য দিকটার প্রতি তাঁহার চোখের দৃষ্টিকে অসামান্যরূপে স্বচ্ছ করিয়া দিয়াছে। কোন ধর্মের বিরুদ্ধেই তাঁহার নালিশ নাই, এবং মানুষ খাঁটি হইলেই যে সকল ধর্মই তাঁহাকে খাঁটি জিনিসটি দিতে পারে, ইহাই তিনি অকপটে বিশ্বাস করেন। এরূপ অসাম্প্রদায়িক মতবাদ বিলাসবিহারীর কানে গেলে তাঁহার আচার্য পদ বহাল থাকিত কিনা ঘোর সন্দেহ, কিন্তু বৃদ্ধের শান্ত, সরল ও বিদ্বেষ-লেশহীন কথা শুনিয়া নরেন্দ্র মুগ্ধ হইয়া গেল। রাসবিহারী ও বিলাসবিহারীরও তিনি অনেক গুণগান করিলেন। তিনি যাহারই কথা বলেন, তাহারই মত সাধু পুরুষ জগতে আর দ্বিতীয় দেখেন নাই বলেন। বৃদ্ধের মানুষ চিনিবার এই অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করিয়া নরেন্দ্র মনে মনে হাসিল। পরিশেষে বিলাসের প্রসঙ্গেই তিনি আগামী বৈশাখে বিবাহের উল্লেখ করিয়া অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সহিত জানাইলেন যে, সে উপলক্ষে তাঁহাকেই আচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হইবে ইহাই বিজয়ার অভিলাষ; এবং এই বিবাহই যে ব্রাহ্মসমাজে বিবাহের যথার্থ আদর্শ হওয়া উচিত এই প্রকার অভিমত প্রকাশ করিতেও তিনি বিরত হইলেন না।

কিন্তু বৃদ্ধ সৌভাগ্য ও আনন্দের আতিশয্যে নিজে এতদূর বিহ্বল হইয়া না উঠিলে অত্যন্ত অনায়াসেই দেখিতে পাইতেন, এই শেষের আলোচনা কি করিয়া তাঁহার শ্রোতার মুখের উপর কালির উপর কালি ঢালিয়া দিতেছিল।

স্নানাহারের জন্য তিনি নরেন্দ্রকে যৎপরোনাস্তি পীড়াপীড়ি করিয়াও রাজী করাইতে পারিলেন না। ঘণ্টা-দেড়েক পরে নরেন্দ্র যখন যথার্থ শ্রদ্ধাভরে তাঁহাকে নমস্কার করিয়া বাহির হইয়া গেল তখন কোথায় যে তাহার ব্যথা, কেন যে সমস্ত মন উদ্‌ভ্রান্ত-বিপর্যস্ত, সমস্ত সংসার এরূপ তিক্ত, বিস্বাদ হইয়া গেছে তাহা জানিতে তাহার বাকী রইল না। নদী পার হইতেই বাম দিকে অনেকদূরে জমিদার-বাটীর সৌধ-চূড়া চোখে পড়ায় আর একবার নূতন করিয়া তাহার দুই চক্ষু জ্বলিয়া গেল। সে মুখ ফিরাইয়া লইয়া সোজা মাঠের পথ ধরিয়া রেলওয়ে