পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/২৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভালবাসার কথা বিজয়ার মনে স্থান পায় না। বরঞ্চ, সন্ধ্যার ঘনীভূত অন্ধকারে একাকী ঘরের মধ্যে সঙ্গ-বিহীন প্রাণটা যখন ব্যথায় ব্যাকুল হইয়া উঠে, তখন কল্পনার নিঃশব্দ-পদসঞ্চারে ধীরে ধীরে যে আসিয়া তাহার পাশে বসে, সে বিলাস নয়, আর একজন। অলস মধ্যাহ্নে বইয়ে যখন মন বসে না, সেলাইয়ের কাজও অসহ্য বোধ হয়, প্রকাণ্ড শূন্য বাড়িটা রবি-করে খাঁ খাঁ করিতে থাকে তখন সুদূর ভবিষ্যতে একদিন এই শূন্য গৃহই পূর্ণ করিয়া যে ঘরকন্নার স্নিগ্ধ ছবিটি তাহার অন্তরে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতে থাকে, তাহার মধ্যে কোথাও বিলাসের জন্য এতটুকু স্থান থাকে না।অথচ, যে লোকটি সমস্ত জায়গা জুড়িয়া বসে, সংসার-যাত্রার দুর্গম পথে সহায় বা সহযোগী হিসাবে মূল্য তাহার বিলাসের অপেক্ষা অনেক কম। সে যেমন অপটু, তেমনি নিরুপায়। বিপদের দিনে ইহার কাছে কোন সাহায্যই মিলিবে না। তবুও এই অকেজো মানুষটারই সমস্ত অকাজের বোঝা সে নিজে সারাজীবন মাথায় লইয়া চলিতেছে মনে করিতেও বিজয়ার সমস্ত দেহ-মন অপরিমিত আনন্দবেগে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে। বিলাস চলিয়া গেলে বিজয়ার এই মনোভাবের আজও যে কোন ব্যতিক্রম ঘটিল তাহা নহে, কিন্তু আজ সে বিনা প্রার্থনায় বিলাসের দোষের পুনর্বিচারের ভার হাতে তুলিয়া লইল, এবং ঘটনাচক্রে তাহার স্বভাবের যে পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে বাস্তবিক স্বভাব যে তাহার এত হীন নহে, কাহারও সহিত কোন তর্ক না করিয়া সে আপনা-আপনি তাহা মানিয়া লইল। এমন কি, নিরতিশয় উদারতার সহিত ইহাও আজ সে আপনার কাছে গোপন করিল না যে, বিলাসের মত মানসিক অবস্থায় পড়িয়া জগতে অধিকাংশ লোকেই হয়ত ভিন্নরূপ আচরণ দেখাইতে পারিত না। সে যে ভালবাসিয়াছে এবং ভালবাসার অপরাধই তাহাকে লাঞ্ছিত এবং দণ্ডিত করিয়াছে, ইহাই বার বার স্মরণ করিয়া আজ সে করুণামিশ্রিত মমতার সহিত তাহাকে মার্জনা করিল।

সকালে উঠিয়া শুনিল, বিলাস বহুপূর্বেই লোকজন লইয়া ঘর-সাজানোর কাজে লাগিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া নীচে নামিয়া আসিয়া লজ্জিতভাবে কহিল, আমাকে ডেকে পাঠান নি কেন?

বিলাস স্নিগ্ধস্বরে বলিল, দরকার কি!

বিজয়া একটু হাসিয়া প্রসন্নমুখে জবাব দিল, আমি বুঝি এতই অকর্মণ্য যে এদিকেও কিছু সাহায্য করতে পারিনে? আচ্ছা, এখন বলুন আমি কি করব?

অনেক দিনের পর বিলাস আজ হাসিল, কহিল, তুমি শুধু নজর রেখো, আমাদের কাজে ভুল হচ্ছে কিনা।