পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/৩৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিজয়া মুখ না ফিরাইয়াই অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিল, নিশ্চয় এই আপনার সত্যিকার মত।

নরেন্দ্র কহিল, না। আমাকে পরীক্ষা করলে টের পেতেন, এ আমার সত্যিকার কেন, মিথ্যাকার মতও নয়। তা ছাড়া, নলিনীর কথা নিয়ে আপনি মিথ্যে কেন কষ্ট পাচ্ছেন? আমি জানি, তাঁর মন কোথায় বাঁধা আছে; এবং আমিও যে কেন পৃথিবীর আর এক প্রান্তে পালাচ্ছি, সে তিনিও ঠিক বুঝবেন। সুতরাং আমার যাওয়া নিয়ে আপনি নিরর্থক উদ্বিগ্ন হবেন না।

বিজয়া বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তাঁর অমত না হলেই আপনি যেখানে খুশী যেতে পাবেন মনে করেন?

নরেনের বুকের মধ্যে কথাগুলো তড়িৎ-রেখার ন্যায় শিহরিয়া উঠিল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিও গিয়া টেবিলের উপরে সেই লাল রঙের নিমন্ত্রণ-পত্রের উপর পড়িল। সে এক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, সে ঠিক, আমি আপনার অমতেও কিছু করতে পারিনে। কিন্তু আপনি ত আমার সমস্ত কথাই জানেন। আমার জীবনের সাধও আপনার অজ্ঞাত নেই। বিদেশে সে সাধ হয়ত একদিন পূর্ণ হতেও পারে; কিন্তু এ দেশে এত বড় নিষ্কর্মা দীন-দরিদ্রের থাকা না-থাকায় কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আমাকে যেতে বাধা দেবেন না।

বিজয়া আনত-মুখে ক্ষণকাল নির্বাক থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আপনি দীন-দরিদ্র ত নয়। আপনার সমস্তই আছে, ইচ্ছে করলেই ত সমস্ত ফিরে নিতে পারেন!

নরেন কহিল, ইচ্ছে করলেই পারিনে বটে, কিন্তু আপনি যে দিতে চেয়েছিলেন, সে আমার মনে আছে, এবং চিরদিন মনে থাকবে। কিন্তু দেখুন, নেবারও একটা অধিকার থাকা চাই—সে অধিকার আমার নেই।

বিজয়া তেমনি অধোমুখে থকিয়াই প্রত্যুত্তর করিল, আছে বৈ কি! বিষয় আমার নয়, বাবার। নইলে সেদিন তাঁর যথাসর্বস্ব দাবীর কথা আপনি পরিহাসচ্ছলেও মুখে আনতে পারতেন না। আমি হলে কিন্তু এখানেই থামতুম না। তিনি যা দিয়ে গেছেন, সমস্ত জোর করে দখল করতুম, তার একতিল ছেড়ে দিতুম না।

নরেন কোন কথা কহিল না। বিজয়াও আর কিছু না বলিয়া নতনেত্রে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। মিনিট-দুই এমনি নীরবে কাটিবার পরে অকস্মাৎ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চকিত হইয়া বিজয়া মুখ তুলিতেই দেখিতে পাইল, নরেনের সমস্ত চেহারাটা যেন কি এক রকম হইয়া গেছে। দুজনের