পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (সপ্তম সম্ভার).djvu/৩৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অপ্রকাশিত রচনাবলী ভিতর দিয়া অমৃক্ষণ বহিয়া যাইতে থাকে। বাহিরের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় যাবতীয় বস্তুকে সে গ্রহণও করে, আবার ত্যাগও করে। যাহাতে তাহার আবশ্বক নাই, যে বস্তু দূষিত, তাহাকে পরিবর্জন করাই তাহার প্রাণের ধৰ্ম্ম । কিন্তু মরিলে আর যখন ত্যাগ করিবার ক্ষমতা থাকিবে না, তখনই তাহাতে বাহির হইতে যাহা আসে, তাহার কায়েম হইয়া বসিয়া যায় এবং মৃতদেহটাকে পচাইয়া তোলে। জীবন্ত সমাজ এ-নিয়ম স্বভাবতই জানে। সে জানে, যে বস্তু আর তাহার কাজে লাগিতেছে না, মমতা করিয়া তাহাকে ঘরে রাখিলে মরিতেই হইবে । সে জানে, আবর্জনার মত তাহাকে ঝাটাইয়া না ফেলিয়া দিয়া, অনর্থক ভার বহিয়া বেড়াইলে, অনর্থক শক্তিক্ষয় হইতে থাকিবে এবং এই ক্ষয়ই একদিন তাহাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দিবে। কিন্তু জীবনীশক্তি যত হ্রাস পাইতে থাকে, প্রবাহ যতই মন্দ হইতে মন্দতর হইয়া আসিতে থাকে, যতই তাহার দুর্বলতা দুষ্টের ঘাড় ধরিয়া বাহির করিয়া দিতে ভয় পায়, ততই তাহার ঘরে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ভাল-মন্সের বোঝা জমাট বাধিয়া উঠিতে থাকে। এবং সেইসমস্ত গুরুভার মাথায় লইয়া সেই জরাতুর মরণোন্মুখ সমাজকে কোনমতে লাঠিতে ভর দিয়া ধীরে ধীরে সেই শেষ আশ্রয় যমের বাড়ির পথেই যাইতে হয় । ইহার কাছে এখন সমস্তই সমান। ভালও ধা, মন্দও তাই ; সাদাও যেমন, কালও তেমনই । কারণ জানিলে তবেই কাজ করা যায়, অবস্থার সহিত পরিচয় থাকিলেই তবে ব্যবস্থা করিতে পারা যায়। এখানকার এই জরাতুর সমাজ জানেই না—কিজষ্ঠ বিধি প্রবর্তিত হইয়াছিল, কেনই বা তাহা প্রকারাস্তরে নিষিদ্ধ হইয়াছিল। মানুষের কোন দুঃখ সে দূর করিতে চাহিয়াছিল, কিংবা কোন পাপের আক্রমণ হইতে সে আত্মরক্ষা করিবার জন্য এই অর্গল টানিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়াছিল। নিজের বিচার-শক্তি ইহার নাই, পরের কাছেও যে সমস্ত গন্ধমাদন তুলিয়া লইয়া হাজির করিবে—সে জোরও ইহার গিয়াছে। স্বতরাং, এখন এ শুধু এই বলিয়া তর্ক করে যে, এইসকল শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ আমাদেরই ভগবান ও পরমপূজ্য মুনি-ঋষির তৈরী। এই তপোবনেই তারা মৃতসজীবনী লতাটি পুতিয়া গিয়াছিলেন। স্বতরাং, যদিচ প্রক্ষিপ্ত শ্লোক ও নিরর্থক ব্যাখ্যারূপ গুল্ম ও কণ্টকতৃণে এই তপোবনের মাঠটি সম্প্রতি সমাচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই পরম শ্রেয়ঃ ইহারই মধ্যে কোথাও প্রচ্ছন্ন হইয়া আছেই। অতএব আইস, হে সনাতন হিন্দুর দল, আমরা এই হোম-ধুম-পূত মাঠের সমস্ত ঘাস ও তৃণ চক্ষু মুদিয়া নিৰ্ব্বিকারে চৰ্ব্বণ করিতে থাকি। আমরা অমৃতের পুত্ৰ—স্বতরাং সেই অমৃত-লতাটি একদিন যে আমাদের দীর্ঘ জিহায় আটক খাইবেই, তাহাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই।