পাতা:শ্রীকান্ত - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নিতুল > নির্ভুল

শ্ৰীকান্ত SS মনে মনে বলিলাম, থাকার নিমন্ত্রণ শেষ হইয়া যখন যাওয়াটাই কেবল বাকি থাকে সে কি ব্যথার বস্তু ! অথচ এ ব্যথার অংশী নাই, শুধু আমারই হৃদয়ে গহবর খনিয়া এই নিন্দিত বেদনাকে চিরদিন একাকী থাকিতে হইবে । রাজলক্ষ্মীকে ভালবাসিবার অধিকার স সারা আমাকে দেয় নাই ; এই একাগ্র প্ৰেম, এই হাসি-কান্না, মান-অভিমান, এই ত্যাগ, এই নিবিড় মিলন-সমস্তই লোকচক্ষে যেমন ব্যর্থ এই আসন্ন বিচ্ছেদের অসহ অন্তদােহও বাহিরের দৃষ্টিপাতে আজ তেমনি অর্থহীন। আজ এই কথাটাই আমার সবচেয়ে বেশি বাজিতে লাগিল, একের মন্মান্তিক দুঃখ যখন অপরের কাছে উপহাসেব বস্তু হইয়া দাড়ায়, তাহার চেয়ে ট্রাজিডি পৃথিবীতে আব্ব আছে কি! অথচ এমনিই বটে। লোকের মধ্যে বাস করিয়াও যে লোক লোকাচার মানে নাই, বিদ্রোহ করিয়াছে, সে নালিশ করিবে গিয়া কাহার কাছে ? এ সমস্যা সনাতন, শাশ্বত, পুরাতন। সৃষ্টির দিন হইতে আজি পৰ্যন্তও এই প্ৰশ্নই বারংবার আবৰ্ত্তিয়া চলিয়াছে, এবং ভবিষ্যতের গর্ভে যতদূব দৃষ্টি যায় ইহার সমাধান চােখে পড়ে না। ইহা অন্যায়, অবাঞ্ছিত । তথাপি এতবড় সম্পদ, এতবড় ঐশ্বৰ্য্যই কি মানুষের আর আছে ? অবাধ্য নরনারীর এই অবাঞ্ছিত হৃদয়াবেগের কত নিঃশব্দ বেদনার ইতিহাসকেই না। মাঝখানে রাখিয়া যুগে যুগে কত পুরাণ, কত কাহিনী, কত কাব্যেরই না অভ্ৰভেদী সৌধ গড়িয়া উঠিয়াছে ? কিন্তু আজ যদি থামিয়া যায় ? মনে মনে বলিলাম, থাক, রাজলক্ষ্মীর ধন্মে মতি হোক, তাহার বক্ৰেশ্বরের রাস্তা সুগম হোক, তাহার। মস্ত্ৰোচ্চারণ নির্ভুল হােক, আশীব্বাদ করি তাহার পুণ্যাজনের পথ নিরন্তর নিৰ্কিবল্প ও নিষ্কণ্টক হোক, আমার দুঃখের ভার। আমি একাই বহন করিব। পরদিন ঘুম ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গেই যেন মনে হইল গঙ্গামাটির এই বাড়ীঘর, পথ-ঘাট, খোলা মাঠ, সকল বন্ধনই যেন আমার শিথিল হইয়া গেছে। রাজলক্ষ্মী কবে ফিরিবে তাহার স্থিরতা নাই, কিন্তু মন যেন আর একটা দণ্ডও এখানে থাকিতে চাহে না । স্নানের জন্য রতন তাগিদ। সুরু করিয়াছে। কারণ, যাইবার সময় রাজলক্ষ্মী শুধু কড়া হুকুম দিয়াই নিশ্চিন্ত হইতে পারে নাই, রতনকে তাহার পা ছুয়াইয়া দিব্য করাইয়।