পাতা:সংগীত চিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংগীত চিন্তা
সংগীত ও কবিতা

আমরা ইতিপুর্বে ভারতীতে সংগীতকে ভাবপ্রকাশের উপায়-স্বরূপে উল্লেখ করিয়াছিলাম। এবারেও আমরা আর-এক দিক দিয়া তাহাই করিব। আমরা কবিতাকে যে চক্ষে দেখি, সংগীতকেও ঠিক সেই চক্ষে দেখিব। বলা বাহুল্য, আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি, তখন তাহাকে আমরা শুদ্ধমাত্র কথার সমষ্টি স্বরূপে দেখি না—কথার সহিত ভাবের সম্বন্ধ বিচার করি। ভাবই মুখ্য লক্ষ্য। কথা ভাবের আশ্রয়-স্বরূপ। আমরা সংগীতকেও সেইরূপে দেখিতে চাই। সংগীত সুরের রাগরাগিণী নহে, সংগীত ভাবের রাগরাগিণী। আমাদের কথা এই যে— কবিতা যেমন ভাবের ভাষা, সংগীতও তেমনি ভাবের ভাষা। তবে, কবিতা ও সংগীতে প্রভেদ কী? আলোচনা করিয়া দেখা যাক।

 আমরা সচরাচর যে ভাষায় কথা কহিয়া থাকি তাহা যুক্তির ভাষা। ‘হাঁ’ কি ‘না’, ইহা লইয়াই তাহার কারবার। ‘আজ এখানে গেলাম’, ‘কাল সেখানে গেলাম’, ‘আজ সে আসিয়াছিল’, ‘কাল সে আসে নাই’, ‘ইহা রুপা’, ‘উহা সোনা’ ইত্যাদি। এসকল কথার উপর যুক্তি চলে। ‘আজ আমি অমুক জায়গায় গিয়াছিলাম’ ইহা আমি নানা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করিতে পারি। দ্রব্যবিশেষ রুপা কি সোনা ইহাও নানা যুক্তির সাহায্যে আমি অন্যকে বিশ্বাস করাইয়া দিতে পারি। অতএব সচরাচর আমরা যে-সকল বিষয়ে কথোপকথন করি, তাহা বিশ্বাস করা না-করা যুক্তির ন্যূনাধিক্যের উপর নির্ভর করে। এই-সকল কথোপকথনের জন্য আমাদের প্রচলিত ভাষা অর্থাৎ গদ্য নিযুক্ত রহিয়াছে।

 কিন্তু বিশ্বাস করাইয়া দেওয়া এক, আর উদ্রেক করাইয়া দেওয়া স্বতন্ত্র। বিশ্বাসের শিকড় মাথায়, আর উদ্রেকের শিকড় হৃদয়ে। এই জন্য বিশ্বাস করাইবার জন্য যে ভাষা, উদ্রেক করাইবার জন্য সে ভাষা নহে। যুক্তির ভাষা গদ্য আমাদের বিশ্বাস করায়, আর কবিতার ভাষা আমাদের উদ্রেক করায়। যে-সকল কথায় যুক্তি খাটে তাহা অন্যকে বুঝানো অতিশয় সহজ; কিন্তু যাহাতে যুক্তি খাটে না, যাহা যুক্তির আইনকানুনের মধ্যে ধরা দেয় না, তাহাকে

১৯