পাতা:সংগীত চিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংগীতচিন্তা

বুঝানো সহজ ব্যাপার নহে। ‘কেন’-নামক একটা চশমা-চক্ষু দুর্দান্ত রাজাধিরাজ যেমনি কৈফিয়ত তলব করেন, অমনি সে আসিয়া হিসাবনিকাশ করিবার জন্য হাজির হয় না। যে-সকল সত্য মহারাজ ‘কেন’র প্রজা নহে, তাহাদের বাসস্থান কবিতায়। আমাদের হৃদয়গত সত্য-সকল ‘কেন’কে বড়ো একটা কেয়ার করে না। যুক্তির একটা ব্যাকরণ আছে, অভিধান আছে, কিন্তু আমাদের রুচির অর্থাৎ সৌন্দর্যজ্ঞানের আজ পর্যন্ত একটা ব্যাকরণ তৈয়ারি হইল না। তাহার প্রধান কারণ, সে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে নির্ভয়ে বাস করিয়া থাকে— এবং সে দেশে ‘কেন'-আদালতের ওয়ারেণ্ট জারি হইতে পারে না। একবার যদি তাহাকে যুক্তির সামনে খাড়া করিতে পারা যাইত, তাহা হইলেই তাহার ব্যাকরণ বাহির হইত। অতএব, যুক্তি যে-সকল সত্য বুঝাইতে পারে না বলিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছে, কবিতা সেই-সকল সত্য বুঝাইবার ভার নিজস্কন্ধে লইয়াছে। এই নিমিত্ত স্বভাবতই যুক্তির ভাষা ও কবিতার ভাষা স্বতন্ত্র হইয়া পড়িয়াছে। অনেক সময় এমন হয় যে, শত-সহস্র প্রমাণের সাহায্যে একটা সত্য আমরা বিশ্বাস করি মাত্র, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে সে সত্যের উদ্রেক হয় না। আবার অনেক সময়ে একটি কথায় আমাদের হৃদয়ে একটি সত্যের উদ্রেক হইয়াছে, শত-সহস্র প্রমাণে তাহা ভাঙিতে পারে না। একজন নৈয়ায়িক যাহা পারেন না একজন বাগ্মী তাহা পারেন। নৈয়ায়িকে ও বাগ্মীতে প্রভেদ এই— নৈয়ায়িকের হস্তে যুক্তির কুঠার ও বাগ্মীর হস্তে কবিতার চাবি। নৈয়ায়িক কোপের উপর কোপ বসাইতেছেন, কিন্তু হৃদয়ের দ্বার ভাঙিল না; আর বাগ্মী কোথায় একটু চাবি ঘুরাইয়া দিলেন, দ্বার খুলিয়া গেল। উভয়ের অস্ত্র বিভিন্ন।

 আমি যাহা বিশ্বাস করিতেছি তোমাকে তাহাই বিশ্বাস করানো আর আমি যাহা অনুভব করিতেছি তোমাকে তাহাই অনুভব করানো— এ দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করিতেছি একটি গোলাপ সুগোল, আমি তাহার চারি দিক মাপিয়া-জুকিয়া তোমাকে বিশ্বাস করাইতে পারি যে গোলাপ সুগোল। আর আমি অনুভব করিতেছি যে, গোলাপ সুন্দর; হাজার যুক্তির দ্বারা তোমাকে অনুভব করাইতে পারি না যে, গোলাপ সুন্দর। তখন কবিতার সাহায্য অবলম্বন করিতে হয়। গোলাপের সৌন্দর্য আমি যে উপভোেগ

২০