পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৮
সোনার তরী

কেবল বুড়া রাজা প্রতাপরায় কাঠের মতো বসি আছে।
বরজলাল ছাড়া কাহারো গান ভালো না লাগে তার কাছে
বালকবেলা হতে তাহারি গীতে দিল সে এতকাল যাপি—
বাদলদিনে কত মেঘের গান, হোলির দিনে কত কাফি।
গেয়েছে আগমনী শরৎ প্রাতে, গেয়েছে বিজয়ার গান—
হৃদয় উছসিয়| অশ্রুজলে ভাসিয়া গেছে দু নয়ান।
যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে সভার গৃহ গেছে পূরে,
গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা ভূপালি মূলতানি সুরে।

ঘরেতে বারবার এসেছে কত বিবাহ-উৎসবরাতি।
পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস, জ্বলেছে শত শত বাতি।
বসেছে নব বর সলাজ মুখে পরিয়া মণি-আভরণ,
করিছে পরিহাস কানের কাছে সমবয়সী প্রিয়জন,
সামনে বসি তার বরজলাল ধরেছে শাহানার সুর—
সে-সব দিন আর সে-সব গান হৃদয়ে আছে পরিপূর।
সে ছাড়া কারো গান শুনিলে তাই মর্মে গিয়ে নাহি লাগে,
অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।
প্রতাপরায় তাই দেখিছে শুধু কাশীর বৃথা মাথা নাড়া—
সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়, হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া।

থামিল গান যবে ক্ষণেক-তরে বিরাম মাগে কাশীনাথ।
বরজলাল-পানে প্রতাপরায় হাসিয়া করে আঁখিপাত।
কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ কহিল, ‘ওস্তাদ জি,
গানের মতো গান শুনায়ে দাও, এরে কি গান বলে, ছি!
এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে শিকারি বিড়ালের খেলা।
সেকালে গান ছিল, একালে হায় গানের বড়ো অবহেলা।’

বরজলাল বুড়া, শুক্লকেশ, শুভ্র উষ্ণীষ শিরে,
বিনতি করি সবে সভার মাঝে আসন নিল ধীরে ধীরে।