পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭৪
চিত্রা

চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র; পশ্চাতে বাঁধি সার
গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার।
শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপথানি;
মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার, কারো মুখে নাই বাণী।
কত-না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার
সহসা দেখিনু, সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার।
কী দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব, হয়ে যায় মনোভুল—
নানা বরনের আলোক সেথায়, নানা বরনের ফুল;
কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত;
মণিবেদিকায় কুসুমশয়ন স্বপ্নরচিতমত।
পাদপীঠ-’পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ;
আমি কহিলাম, ‘সব দেখিলাম, তোমারে দেখি নি শুধু!’

চারি দিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুকহাসি,
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি।
সুধীরে রমণী দু বাহু তুলিয়া অবগুণ্ঠনখানি
উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী।
চকিত নয়ানে হেরি মুখ-পানে পড়িনু চরণতলে—
‘এখানেও তুমি জীবনদেবতা!’ কহিনু নয়নজলে।
সেই মধু মুখ, সেই মৃদু হাসি, সেই সুধা-ভরা আঁখি—
চিরদিন মোরে হাসালো কাঁদালো, চিরদিন দিল ফাঁকি!
খেলা করিয়াছে নিশিদিন মোর সব সুখে সব দুখে,
এ অজানা পুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে!
অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে—
বাধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে;
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি।

জোড়াসাঁকো। কলিকাতা
২০ ফাল্গুন ১৩০২