পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮
মানসী

আপন ললিত রাগিণী শুনিয়া আপনি অবশমন;
ডুবাইতে থাকে কুসুমগন্ধ বসন্তসমীরণ।
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে, ফুল মোরে ঘিরে বসে—
কেমনে না জানি জ্যোৎস্নাপ্রবাহ সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে ভুবনমোহিনী মায়া;
যৌবনভরা বাহুপাশে তার বেষ্টন করে কায়া।
চারি দিকে ঘিরি করে আনাগোনা কল্পমুরতি কত;
কুসুমকাননে বেড়াই ফিরিয়া যেন বিভোরের মতো।

শ্লথ হয়ে আসে হৃদয়তন্ত্রী, বীণা খসে যায় পড়ি;
নাহি বাজে আর হরিনামগান বরষ বরষ ধরি।
হরিহীন সেই অনাথ বাসনা পিয়াসে জগতে ফিরে;
বাড়ে তৃষা, কোথা পিপাসার জল অকূল লবণনীরে!
গিয়েছিল দেবী, সেই ঘোর তৃষা তোমার রূপের ধারে;
আঁখির সহিতে আঁখির পিপাসা লোপ করো একেবারে।

ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমার মূর্তি পশেছে জীবনমূলে;
এই ছুরি দিয়ে সে মুরতিখানি কেটে কেটে লও তুলে।
তারি সাথে হায় আঁধারে মিশাবে নিখিলের শোভা যত—
লক্ষ্মী যাবেন, তাঁরি সাথে যাবে জগৎ ছায়ার মতো।

যাক, তাই যাক, পারি নে ভাসিতে কেবলি মুরতিস্রোতে;
লহো মোরে তুলে আলোকমগন মুরতিভুবন হতে।
আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে; একাকী অসীম-ভরা
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন, মিলাবে সকল ধরা।
আলোহীন সেই বিশাল হৃদয়ে আমার বিজন বাস;
প্রলয়-আসন জুড়িয়া বসিয়া রব আমি বারো মাস।

থামে। একটুকু; বুঝিতে পারি নে, ভালো করে ভেবে দেখি
বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সেকি।