পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উনিশে মে, আমাদের উত্তরাধিকার

 ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় উনিশ’—এই শিরোনামে এবার শিলচর শহরে প্রতিদিন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করা হলো। পঁচিশে বৈশাখ থেকে এগারোই জ্যৈষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। আঁখির দুটি তারা। নিজেদের নতুন ভাবে মনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে: ‘বাঙালিত্বই অন্বিষ্ট—হিন্দুত্ব নয়, মুসলমানত্ব নয়, অন্ধ ও বধিরদের সমাজে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারে একুশে ফেব্রুয়ারি, উনিশে মে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বন্দিত একুশে ফেব্রুয়ারি তবু তো উদ্‌যাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু ১৯৬১ সালের ১৯ মে তো ব্রাত্য ছিল ক-বছর আগেও। আসামের শিলচর শহরে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে গিয়ে ওইদিন এগারো জন শহিদ হয়েছিলেন, সে-খবর বহুলোক জানতেন না এই সেদিন পর্যন্ত। শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহরত বাঙালিদের উপর স্বাধীনতা পরবর্তী গণতান্ত্রিক পর্যায়ে আসাম সরকারের পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আমাদের চেতনায় যতটা আলোড়ন তুলতে পারত, পুনরুজ্জীবনের প্রেরণা দিতে পারত—তা কিন্তু হয়নি। আমাদের পারাপারহীন ঔদাসীন্যে এতটুকু চিড় ধরেনি কোথাও।

 তবু উনিশে মে-র কাছে ফিরে যেতে হয়। নিষ্কর্ষ খুঁজতে হয় পুনর্নির্মাণের। ভাষা আন্দোলন চলমান এক প্রক্রিয়ার নাম: কোনো একটা বিশেষ তারিখ অন্য দিনগুলির তুলনায় উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে, এইমাত্র। ভাষা-সংগ্রামের বহুমুখী মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন করে বুঝি, বৃহত্তর গণসংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ হল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বরকত-সালাম-জব্বারেরা শহিদ হয়েছিলেন বলেই ধাপে ধাপে তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলা নামে দেশের জন্ম-লগ্ন। ইতিহাস ও ভূগোলের যৌথ আক্রমণে বরাক উপত্যকা (আসামের দক্ষিণ অংশে সাবেক কাছাড় জেলা) যেহেতু প্রান্তিকায়িত হয়ে পড়েছিল, তার গভীর সর্বাত্মক সংকট কখনো তেমন মনোযোগের বিষয় হয়ে ওঠেনি। বহুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ঐতিহ্যগত ভাবে শ্রীহট্ট বা সিলেট বৃহত্তর বঙ্গভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও ধূর্ত ব্রিটিশ ১৮৭৪ সালে তাকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা-নির্ভর রাষ্ট্রযন্ত্র রাজস্বখাতে অনেকটা লাভবান হল যদিও, ‘বাঙালির আধিপত্য’ নামক জুজুর ভয় দেখতে শুরু করল কেউ কেউ। ক্রমান্বয়ে বিদ্বেষ-বুদ্ধির বিষবৃক্ষে শুধু জল সেচনই করা হল। দেশ বিভাজনের সময় গণভোটে সিলেট আসাম থেকে সরে গিয়ে যুক্ত হল পূর্ব পাকিস্তানে। শুধু সাবেক সিলেটের পূর্ব প্রান্তের কিছু অংশ যুক্ত হল দেশভাগ পরবর্তী কাছাড় জেলার সঙ্গে। এই নতুন কাছাড় ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক-

৫৩